ডেস্ক নিউজ:
রোহিঙ্গাদের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে ১২০টি গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হবে। তাতে পুনর্বাসন করা হবে এক লাখ ৩ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গাকে। এ লক্ষ্যে গত মাসের শেষদিকে একনেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভাসানচরে বসবাসের যাবতীয় সুযোগ সুবিধাই থাকবে। চরটিকে বসবাসের উপযোগী করার পাশাপাশি নিশ্চিত করা হবে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও টেকনাফ উপজেলার বালুখালীতে অস্থায়ী ক্যাম্পে রয়েছে। ক্যাম্পের বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তারা। স্থানীয় জনগণের চেয়েও তারা এখন সংখ্যায় বেশি। তাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের জনজীবন, অর্থনীতি ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, তাদের ফেরত পাঠাতে নেপিদোর সঙ্গে গত মাসেই ঢাকার একটি চুক্তি হলেও এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রেক্ষাপটে ফেরত পাঠানোর আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
উখিয়ার বালুখালীতে পাহাড় দখল করে রোহিঙ্গাদের বসতিগত বছরের অক্টোবর ও এই বছরের ২৫ আগস্ট থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সম্মত হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে মিয়ানমার। সরকার আশা করছে, মিয়ানমারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই এ সমস্যার সমাধান হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে ধরে নিয়েই পর্যটন শহর কক্সবাজারে তাদের আর রাখতে আগ্রহী নয় সরকার।
গত সেপ্টেম্বরে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া না হবে ততদিন অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। এর পরই পুনর্বাসনের প্রাথমিক কাজ শুরু করে নৌবাহিনী। গত মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করার পর রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
ভাসানচরের একাংশএজন্য হাতিয়া থানার চরঈশ্বর ইউনিয়নের চর ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে (বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক) ভাসানচরে পাঠানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ভেসে ওঠা চরটিতে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করাই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। এজন্য সরকার ‘আশ্রয়ণ-৩ (নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানাধীন চরঈশ্বর ইউনিয়নস্থ ভাসনচরে ০১ লাখ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের আবাসন এবং দ্বীপের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ) প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। গত ২৮ নভেম্বর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৩১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় নৌবাহিনী বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের কাজ চলতি বছরে জুলাইয়ে শুরু হয়, যা ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।
প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে এক লাখ ৩ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হবে। তার আগে চরের ভূমি উন্নয়ন ও তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। থাকবে এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউস। নির্মাণ করা হবে ১২০টি শেল্টার স্টেশন, মসজিদ। দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ভবন ও কর্মকর্তাদের জন্য বাসভবন নির্মাণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় থাকবে নলকূপ ও পুকুর।
পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিরাপত্তায় পেরিমিটার ফেন্সিং ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প এলাকা মনিটরিংয়ের জন্য কেনা হবে একটি মাইক্রোবাস, ১২টি মোটরসাইকেল, ২৩টি হিউম্যান হলার, ৪০টি ঠেলাগাড়ি, ৪৩টি ভ্যানগাড়ি, চারটি এলসিইউ এবং আটটি হাই স্পিডবোট। নির্মাণ করা হবে গুদাম। জ্বালানি ট্যাংক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়া, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল ফোন টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসি টিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর ও বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনও নির্মাণ করা হবে ভাসানচর রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
দ্বীপটির অবস্থান নোয়াখালী থেকে প্রায় ২১ নটিক্যাল মাইল, জাহাজির চর থেকে ১১ নটিক্যাল মাইল, সন্দ্বীপ থেকে চার দশমিক ২ নটিক্যাল মাইল, পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে ২৮ নটিক্যাল মাইল এবং হাতিয়া থেকে ১৩ দশমিক ২ নটিক্যাল মাইল দূরে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বিশাল স্রোত দেশের নিরাপত্তা ও পরিবেশ দুটোর জন্যই হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। কক্সবাজারের বিভিন্নস্থানে তাদের বসবাসের স্থান সংকুলান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই তারা বিপুল পরিমাণ পাহাড়ি জমি ও বনাঞ্চল নষ্ট করছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় অধিবাসী ৫ থেকে ৭ লাখ। কিন্তু বর্তমানে নতুন-পুরনো মিলে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। এসব কারণেই তাদের নিজ দেশে পুরোপুরি ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে সরিয়ে ভাসানচরে পাঠানো হবে।
সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর ভাসানচর রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করে নৌবাহিনী। এজন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে ৫০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছিল তারা। কিন্তু তাৎক্ষণিক এ উদ্যোগ নেওয়া উচিত হবে না বলে সেসময়ে ওই বরাদ্দ দেননি অর্থমন্ত্রী।
সূত্রমতে, নৌবাহিনীর প্রস্তাবে বলা হয় ভাসানচর ভাঙন প্রতিরোধসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। সেখানে সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, পানি নিষ্কাশন, পুকুর খনন, স্কুল ও মাদ্রাসাসহ অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি সাইক্লোন সেন্টার ও দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হবে। এজন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে একটি ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন, কর্মসূচি ও আর্থিক প্রাক্কলন তৈরি সময়সাপেক্ষ। কমপক্ষে তিন মাসের প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হয়। সময় নষ্ট না করে নভেম্বরেই কাজ শুরু করা প্রয়োজন। কারণ, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ওই চরের উন্নয়ন কাজ করা সম্ভব। সমুদ্র তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে চরটি অবস্থিত হওয়ায় ভরা মৌসুমে অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে থাকে। এ সময় মৌসুমি বৃষ্টিপাত, বড় বড় ঢেউ, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন কারণে চরটির সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। ফলে শীতকাল ছাড়া অন্য সময় সেখানে কোনও কার্যক্রম হাতে নেওয়া সম্ভব নয়।
এতে আরও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারলে ২০১৮ সালের জুন বা জুলাইয়ে এ চরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে না। এতে পুনর্বাসন কার্যক্রম আরও এক বছর পিছিয়ে যেতে পারে। সূত্রমতে, নৌবাহিনী ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাইলেও প্রাথমিকভাবে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠান অর্থ সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। সেখানে তিনি বলেন, ভাসানচর নৌবাহিনীর নিরাপত্তা অবকাঠামো উন্নয়নে প্রাথমিক কাজ শুরুর জন্য অপ্রত্যাশিত ব্যয় ব্যবস্থাপনা খাত থেকে ১০ কোটি টাকা এবং চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত আরও ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ যেতে পারে। এতে আরও বলা হয়, হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরের ১৩ হাজার একর খাসজমি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উপযোগী করে গড়ে তোলা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন এবং সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ভাসানচরের নিরাপত্তা বিধান, বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বনায়নের জন্য নৌবাহিনীকে সম্মতি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়ার একটি নিয়ম আছে। নিয়ম মেনেই বরাদ্দ দিতে হয়। সেভাবেই রোহিঙ্গাদের জন্য নেওয়া জরুরি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হবে। এতে বিভ্রান্তির কিছু নেই।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।