সিবিএন ডেস্ক:
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) নির্দেশনা মানছে না অনেক সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমনকি আদালতের নির্দেশনা না মানার অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি সূত্রে জানা গেছে, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ভর্তি ও সেশন ফি, ফরম পূরণসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের যুগ্মসচিব (আইন ও নিরীক্ষা) আহমেদ শামীম আল রাজী অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের জারি করা নির্দেশনা অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। এছাড়া মাউশি থেকেও একাধিকবার এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তা মানছে না। অন্যদিকে, শিক্ষক নিয়োগ, শাখা অনুমোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ম মানছেনা বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রী সংসদ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বর্হিক্রিড়া, রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, ম্যাগাজিন, পরিবহন, সেমিনার, উন্নয়ন তহবিল, নিরাপত্তা, নৈশপ্রহরী, ব্যবহারিক পরীক্ষা, পরিচয়পত্র, মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর ড. মো. আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আমরা জানার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু বিষয় আমাদের অজানা থেকে যায়। তবে কেউ অভিযোগ করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগ আছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের বিষয়টি পরিপত্রে নির্দিষ্ট করা থাকলেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে সরকারি স্কুল ও কলেজগুলো। সরকারি এ নির্দেশনার বাইরে অর্থ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই একাডেমিক কাউন্সিলের। এমনকি নিয়ম না মেনেই এক খাতের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসবের প্রেক্ষিতে গত ৩০ আগস্ট মাউশির এক আদেশে সরকারি পরিপত্র অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
অন্যদিকে, শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রেও নিয়ম না মানার অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করছে। ফলে অনেক শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়ার পরও এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে না। আর এমপিওভুক্ত হলেও পরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে শিক্ষক নিয়োগে অর্থ আদায়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’
বিষয়টি স্বীকার করে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এসব ঘটনা ঘটলেও কেউ অভিযোগ করতে চায় না। যে কারণে অনেক সময় আমরা অহসায় হয়ে পড়ি।’
শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার তেঁথুলিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী হাসেম আলীকে তার বকেয়া পাওয়না দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর গত ২৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থ থেকে তার বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ দেয় শিক্ষা অধিদফতর। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা অধিদফতর পাওনা পরিশোধ করতে বলে। তবে অধিদফতরের নির্দেশের তিন মাস পরও সেই পাওনা পরিশোধ করা হয়নি।
এ ব্যাপারে তেঁথুলিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দোলেনা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টাকা পরিশোধের জন্য আমি কমিটিকে বলেছি। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনও ফান্ড না থাকায় টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে (মাউশি) বিষয়টি জানাবো। যেন সরকারি কোষাগার থেকে তার বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হয়।’
এ বিষয়ে নৈশপ্রহরী হাসেম আলী অভিযোগ করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে পারিবারিক মামলা হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে আমার বেতন বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরে আমি হাইকোর্টে মামলা করলে মামলা থেকে অব্যাহতি পাই। আদালত আমার পাওনা পরিশোধেরও নির্দেশ দেন। পাওনা পরিশোধে শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশের পরেও আমার বকেয়া বেতন এক লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে, তাদের এ পাওনা পরিশেধের ক্ষমতা নেই। ফলে আমি এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছি।’
এদিকে, নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার ভেল্লাবাড়িয়া আব্দুল ওয়াহেদ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক এনামুল হক সই জাল করে নিজেই তার নিয়োগ নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার স্থায়ী নিয়োগের পর বিদ্যালয়ের শাখা খুলে ১৩ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে আরও দুইজন শিক্ষক নিয়োগ দেন। এ ঘটনায় শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শকের সই জাল করেন তিনি। পরে গত ২৮ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের উপপরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন এবং সহকারী পরিচালক তানভীর মোশারফ খানকে বিষয়টি তন্তের নির্দেশ দেয় মাউশি।
এ বিষয়ে ভেল্লাবাড়িয়া আব্দুল ওয়াহেদ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক এনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি অন্য স্কুল থেকে এখানে এসেছি। কমিটি আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। নিজে নিজে নিয়োগ স্থায়ী করেছি এটি ঠিক নয়।’
দুই শিক্ষক নিয়োগে ১৩ লাখ টাকা নেওয়ার বিষয়ে এনামুল হক বলেন, ‘শাখা আগেই চালু ছিল। শিক্ষক নেওয়ার বিষয়টি আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। আগের কমিটি আরও বেশি টাকা নেওয়ার কারণে নিয়োগ দেওয়া দু্ইজন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করতে বলে। আমি তা করিনি। ১৭ লাখ টাকা নেওয়ার কথা শুনেছি তবে আমি কোনও টাকা নেইনি।’
শুধু বেসরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠান নয়, সরকারি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নানা অনিয়ম করেও রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। সে কারণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয়, মাউশি ও আদালতের নিয়ম মানছে না বলে জানান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির কর্তকর্তারা জানান।