ডেস্ক নিউজ:
আনিসুল হক। চলার পথে মোটেই স্থির ছিলেন না তিনি। অস্থির ছুটেছেন আজীবন। এই ছুটন্ত জীবনে ক্ষণিকের তরে যেখানেই দাঁড়িয়েছেন, সুবাস ছড়ানো ফুল ফুটেছে কী দারুণ!
৮০’র দশকে বিটিভির অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় জনপ্রিয়তা নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন দ্রুত। ৯০’র দশকে জড়িয়েছেন ব্যবসায়। সফলতা সেখানেও এসেছে দু’হাত ভরে। হয়েছেন জনপ্রিয় ব্যবসায়ী নেতা। অনেককে বিস্মিত করে শেষের দিকে নিজেকে জড়ালেন রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ২০১৫ সালে দাঁড়ালেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। বিপুল গণসমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেন। এখানেও দেখালেন নায়কোচিত সফলতা। বদলে দিতে লাগলেন শহরের খোলনলচে।
দেশের মানুষের কাছে আনিসুল হকের পরিচিতির শুরুটা বিটিভির কয়েকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে। বিশেষ করে ৮০’র দশকে ‘বলা না বলা’ এবং ‘জানতে চাই’ নামের অনুষ্ঠান দুটি উল্লেখযোগ্য। উপস্থাপক হিসেবে আনিসুল হক আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ নামের একটি এক পর্বের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে। ১৯৯১ সালের আলোচিত নির্বাচনের আগে আগে তার এই অনুষ্ঠানে প্রথম এবং শেষবারের মতো মুখোমুখি বসেন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনিসুল হক সে সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান।
বিস্ময়কর তথ্য হলো, এই অনুষ্ঠান এবং জনপ্রিয়তার পর থেকেই আনিসুল হক নিজেকে ক্রমশ সরিয়ে নেন উপস্থাপকের আসন থেকে। তবে এর মধ্যে ঈদ উপলক্ষে তৈরি বিটিভির বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলার’ বেশ ক’টি পর্বে উপস্থাপক হিসেবে পাওয়া গেছে তাকে। এর বাইরে ১৯৯৫ সালের ঈদে ‘জলসা’ নামের একটি গানের অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেন বিটিভিতে। এরপর আর তেমন কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থাপকের আসনে পাওয়া যায়নি এই প্রাণবন্ত মানুষটিকে।
ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক ব্যস্ততার চাপে উপস্থাপনা থেকে নিজেকে মাঝে দীর্ঘ সময় দূরে সরিয়ে রাখলেও দেশের অন্যতম জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে তার কদর ছিল বরাবরই। তাই তো ২০১১ সালে দেশে যখন যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিওনিয়ার’ এর বাংলাদেশ ভার্সন ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ তৈরি ও সম্প্রচারের অনুমতি মেলে; তখন ঘুরে ফিরে অনুষ্ঠানটির যোগ্য সঞ্চালক হিসেবে আয়োজক এবং দর্শকদের কাছে উঠে আসে একজনেরই নাম– তিনি আনিসুল হক। এতে তিনি সম্মতিও দেন। চলে রিহার্সেলও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কাজটি ছেড়ে দেন তার চোখের সমস্যার কারণে। পরে সেটি সঞ্চালনা করেন আসাদুজ্জামান নূর। এটি প্রচারিত হয় দেশ টিভিতে।
উপস্থাপক আনিসুল হক ব্যবসায়িক ব্যস্ততা এবং পরে মেয়রের পাহাড়সম দায়িত্বভার নিয়েও বরাবরই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে। তিনি কখনও মাইক্রোফোন হাতে মঞ্চে গেয়ে উঠেছেন ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’, কখনও পরম ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছেন আলাউদ্দিন আলী, লাকী আখান্দ কিংবা আবদুল জব্বারের মতো কিংবদন্তিদের দুঃসময়ে। শিল্পীদের সাহায্যের জন্য তিনি একক উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’। তিনি বলেছেন, ‘কোনও শিল্পীকে চিকিৎসার জন্য আর কারও কাছে হাত পাততে হবে না। এই ফাউন্ডেশনই শিল্পীদের পাশে থাকবে।’ থেকেছেও।
লাকী আখান্দের সঙ্গে আনিসুল হক (ছবি সংগৃহীত)সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আনিসুল হকের শেষ উদ্যোগের নাম ‘নাগরিক টিভি’। যে টিভি চ্যানেলটি নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। এই টিভি চ্যানেল দিয়ে তিনি পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশীয় গৎবাঁধা টেলিভিশন মাধ্যমের ধারা। চ্যানেলটি সম্প্রচারে আসার কথা ছিল তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পরই।
তবে তার আগেই আনিসুল হক উপদেষ্টা হয়ে গড়ে দিয়ে গেছেন উপস্থাপকদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম। নাম দিয়েছেন– প্রেজেন্টারস প্ল্যাটফর্ম অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনজাম মাসুদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা উপস্থাপকরা একজন পিতাকে হারালাম। তিনি ছিলেন আমাদের সবার অভিভাবক। একজন সৎ, সুন্দর, সংস্কৃতিমনা এবং পরিশ্রমী মানুষকে আমরা হারালাম। আমরা প্রত্যেকে ভাবতে গর্ববোধ করি, আনিস ভাইয়ের শুরুটা উপস্থাপনা দিয়ে আর চলে গেলেন আমাদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে দিয়ে। এটাই আমাদের বড় সান্ত্বনা। একজন উপস্থাপক হিসেবে তিনি তার বৃত্ত পূর্ণ করেই বিদায় নিলেন।’
৬৫ বছর বয়সী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।