মো: আকতার হোছাইন কুতুবী :

কবিতা হলো সংকীর্ণ আলোকোজ্জল মঞ্চে সচতুর নৃত্যপটিয়সীর অলৌকিক নূপুর-নিক্কন, গদ্য-পেশীবহুল দৌঁড় বীরের দীর্ঘ মেয়াদী ম্যারাথন। প্রতিটি অর্জনের সাথে আমরা একটু একটু করে মরে যাই। সাহসীরা জীবনের মর্যাদাকে মূল্য দেয়, ভীরুরা পরিসরকে।
মেঘ ভাঙ্গু রোদ্দুর একটি আধুনিক ও রোমান্টিক ধারার সঙ্গীত সংকলন।
কবি শফিকুল ইসলাম তার কবিতা, গ্রন্থ, গীতিকবিতা সব কিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে নিপুনভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। যেটা পাঠকরা পড়ে আনন্দ পাবে। যারা এই ধারার লেখক তারা কাব্যকে গীতিধর্মীতায় উত্তীর্ণ করেছিলেন। পৃথিবীর সকল লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের মাঝে সঙ্গীতের প্রতি আলাদা একটি দরদ কাজ করে। সঙ্গীতকে ভালবাসেন মনের ভেতর থেকে। আমরা হাজার বছরের বাংলা কবিতার পাঠ থেকে এই সত্য অনুধাবন করি বাঙালী কবি মাত্রই ভাব ও বিষয়কে মুক্তি দিতে সুরের আশ্রয়ী। যে সুর পাঠক ও শ্রোতাকে গভীরভাবে আপ্লুত করে, বাঙালী কবির পক্ষে সে সুরের আশ্রয়ী হওয়া অতি স্বাভাবিক। বাংলা কবিতা বিচিত্র শৈলী ও প্রবণতায় আজ ঋদ্ধ।
‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর’ গ্রন্থটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখলাম, গ্রন্থটি একটি আধুনিক ধারার সঙ্গীত সংকলন। এগুলোকে গীতধর্মী কবিতা ও বলা যায়। তবে সার্থক সঙ্গীতের জন্যে কাব্যগুণের শর্ত তো খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। গ্রন্থটির লেখক শফিকুল ইসলাম একজন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। কবিতা ও লেখনীকে খুব বেশি আপন করে নিয়ে অবসর সময়ে গান, কবিতা লেখালেখি করে সময় কাটান। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার। কবিতা নিয়েই সাহিত্য জগতে তার পদযাত্রা। ‘এই ঘর এই লোকালয়’, ‘একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি’, ‘শ্রাবণ দিনের কাব্য’, তবু ও বৃষ্টি আসুক’, দহন কালের কাব্য’ ও প্রত্যয়ী যাত্রা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তার স্বতন্ত্র কাব্য প্রবণতা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। আর একজন কবির রচিত সঙ্গীত গ্রন্থে ভাব ও সুরের মিশেলে আমরা পেয়ে যাচ্ছি সংবেদনশীল হৃদয়ানুভূতিকে। শফিকুল ইসলামের কাব্য চর্চ্চার মূল বিষয় ও হৃদয় চর্চ্চা। তিনি বিষয়কে হৃদয় রসে জারিত করে প্রকাশে প্রাণান্ত হয়েছেন। এ জন্যই তার এ সঙ্গীত গ্রন্থে ও বিষয়ের মুক্তি ঘটেছে বিশেষভাবেই।
“তোমার হাসি দোলা দিয়ে যাক বন্ধু অধরের কোণে
আমার আখীজল ঢাকা থাক বন্ধু গোপনে।
তোমায় সুখী দেখলে
আমি সব দুঃখ যাই ভুলে,
স্বপ্ন শুধু ছড়িয়ে থাক ও দুটি নয়নে ॥”
মানব হৃদয়ের চিরন্তন প্রেম-বিরহ, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-হতাশা সব কিছুকে লেখক গভীর দরদে স্থান দিয়েছেন তার লেখায়। ‘প্রেম সৃষ্টির একটি অন্যতম নিয়ামক। প্রেম হৃদয়কে বিচিত্র অনুভূতির মুখোমুখি করে। কখনো বিপুল দুঃখ যাতনায় হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে এবং সমৃদ্ধ করে। তাই প্রেমিক হৃদয়ের আর্তিগুলো হয় নিখাদ মনের স্বচছ সুন্দর প্রকাশ। শফিকুল ইসলামের লেখায় চমৎকার সব অনুভূতির শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে।
“এক পশলা বৃষ্টিতে হয়ে যায় শরতের আকাশ নির্মল,
শত বর্ষায় ও কি ফুরাবেনা আমার আখিজল ?
হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায়
প্রদীপশিখা নিমেষে নিভে যায়,
শত দীর্ঘশ্বাসেও নিভে না আমার বুকের অনল?”
শফিকুল ইসলামের লেখায় এই কাব্যধর্মীতার সমন্বয় আমাকে আশান্বিত করেছে।
“আমি অন্ধকার আকাশের তারা, আধারের মাঝে জ্বলি একা একা
আমার গোপন কান্না রাতের গহন আধারে থাকে ঢাকা ॥
নয়নে আমার কত যে ছিল আশার স্বপন
আজ স্বপ্ন আমার ভেঙ্গেছে, ভেঙ্গেছে মনÑ
অশ্রুভেজা আজ এ দুটি আখি কাজল আকা” ॥
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জনপ্রিয় বাংলা আধুনিক গানের যে সব বৈশিষ্ট্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় শফিকুল ইসলাম সেই আধুনিক গানের ধারাতেই নিজেকে যুক্ত করতে চেয়েছেন। এ ধারার গানগুলো বিশেষত মননধর্মী। নিসর্গ আশ্রয়ী ক্যানভাসে সুখদুঃখ, বিরহ-বেদনা মূর্ত করে তোলা হয় এসব গানে । উপমা আর চিত্রকল্পে একটি হৃদয়স্পর্শী অনুভূতির ও সন্নিবেশ ঘটে।
“প্রহরের পর প্রহর কেটে যায় আমি একা জেগে থাকি
তারা-ভরা আকাশের পানে মেলে স্তব্ধ নির্বাক দুটি আখি ॥
কখনো হঠাৎ আসা পবনে
দোলা লাগে ঝাউবনে,
কি যে ঝড় বয়ে যায় আমার প্রাণে-
গন্ধশেষ দগ্ধ ধূপের মত আমি একা পড়ে থাকি ॥
কিংবাÑ
“এই মন হয় রঙিন তোমার কাছে এসে
কথাগুলো গান হয় তোমাকে ভালবেসে ॥
এই নয়নে যখন রাখো দুনয়ন
এই কাধে হাত রাখো যখন-
মন হারায় কোন স্বপনের অজানা দেশে ॥
কিংবা-
“যতবার ভাবি আর পিছু ডাকবনা
দুচোখের জল আর কিছুতে মানে না মানা ॥
জানি পিছু ফিরে তাকাবার
নেই তো আজ অবসর তোমার,
নয়ন ফেরানো যায় যদি মন তো আর ফেরানো ॥
গানের চূড়ান্ত মুক্তি হতে পারে যথার্থ সুরারোপে। ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর’ গ্রন্থের শতাধিক গানের যথার্থ সুরারোপ গানগুলো মননশীল ধারার শ্রোতাদের মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস। শফিকুল ইসলাম নীরবে নিভৃতে যে শিল্পবোধ গড়ে তুলেছেন গ্রন্থটি পাঠ করে তার অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর’ গ্রন্থের লেখাগুলোকে লিরিক কবিতা হিসাবেও বিবেচনা করা যায়। তবে যে ভাবেই বিবেচনা করিনা কেন শফিকুল ইসলামের বেদনাহত হৃদয়ের সংরক্ত শিল্প নির্যাসই এখানে ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর’ হয়ে ধরা দেয়।

গ্রন্থ পর্যালোচনায় : মো: আকতার হোছাইন কুতুবী, সহ-সম্পাদক জাতীয় দৈনিক আমার কাগজ, দি গুডমর্নিং ও প্রধান সম্পাদক, জাতীয় ম্যাগাজিন জনতার কণ্ঠ এবং উপদেষ্টা সম্পাদক-জাতির আলো, ঢাকা।