ডেস্ক নিউজ:

বাংলাদেশে এভাবেই দলে দলে এসেছে রোহিঙ্গারাচলমান রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে সরাসরি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। এর বাইরে আঞ্চলিক দেশগুলোর রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। শনিবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের ওপর যেসব প্রভাব পড়ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনৈতিক। এতে ওই অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়ছে, দিনমজুরের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বর্তমান সংকেট দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানান মিয়ানমার বাংলাদেশ চেম্বারের প্রেসিডেন্ট রাশেদ মাকছুদ খান।

বেশিরভাগ বক্তাই জানান, রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নয়, আন্তর্জাতিক। ফলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে এটি মোকাবিলা করতে হবে।

সিপিডি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের কারণে চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ছয় মাসে ১ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আর সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে আরও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী হিসাবে সিপিডি দেখেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা জরুরি। যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া এই পরিমাণ অর্থ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের দশমিক ০৩ শতাংশ ও মোট রাজস্বের ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বড় প্রভাব পড়ছে সামাজিক খাতে। জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, আইনশৃঙ্খলা ও স্থানীয় জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে মাদক, পতিতাবৃদ্ধি ও মানবপাচার বাড়তে পারে।’

সিপিডির নির্বাহী পরিচালকের ভাষ্য, ‘পরিবেশের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের ঝুঁকি। বিশেষ করে জমি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মাটি কেটে নেওয়ায় বাড়ছে ঝুঁকি। সুপেয় পানি ও গাছপালা কমছে। আর এই সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে তা সামাল দেওয়ার সমস্যা বাংলাদেশের রয়েছে কিনা তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

মিয়ানমার প্রতিবেশী রাষ্ট্র, তাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই সমস্যার সমাধান করতে হবে বলে অভিমত দিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। তার কথায়, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা মানবিক সংকটে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি মাত্র। আমাদের সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও এত মানুষের আশ্রয়ের ব্যাপারে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে দুই দেশের সংঘাত সৃষ্টির উপায় নেই। কোনোভাবেই বাংলাদেশের মাটি ও ভূমি মিয়ানমারের বিপক্ষে ব্যবহার হবে না। তবে আরসার (আরাকান সলভেনশন আর্মি) ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছি।’

রোহিঙ্গাদের কারণে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ঝুঁকির আশঙ্কার দিকটি উড়িয়ে দিচ্ছেন না পররাষ্ট্র সচিব। তার ভাষ্য, ‘সবকিছু সরকারের নজরে আছে। এখানে যেন উগ্রপন্থী তৈরি না হয়, সেই ব্যাপারে সচেতন রয়েছে সরকার। পাশাপাশি এনজিওদের ব্যাপারেও সরকার অত্যন্ত সতর্ক। তবে জাতিসংঘসহ বিদেশি মিশনগুলো কোনও শর্ত ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করছে।’

পররাষ্ট্র সচিব আরও জানান— রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনও দেশে আশ্রয়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তৃতীয় কোনও দেশ পাওয়া যায়নি যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আগ্রহী।

সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যায় দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি বলেছেন, ‘এ সমস্যা বেশিদিন জিইয়ে রাখা যাবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ মিয়ানমারের এই সমস্যার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। এখনও দেশটি গণতান্ত্রিক সমস্যা মোকাবিলা করছে। সেখানে পূর্ণাঙ্গভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বলেন, ‘সমস্যাটি রাজনৈতিক ও জটিল। এর সঙ্গে অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতি জড়িত। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সামনে এগোনোর আগে ভাবতে হবে চীন ও মিয়ানমারের সম্পর্ক। দুই দেশের তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন আর হাইড্রো পাওয়ারের সুবাদে দুই দেশের সম্পর্ক খুবই গভীর। এছাড়া বতর্মানে মিয়ানমারে চীনের ২৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।’

রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতাকে গণহত্যা হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ সুলতান। তার ভাষ্য, ‘গণহত্যা কোনও দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। এটি আন্তর্জাতিক বিষয়। তাই এটিকে মোকাবিলা করতে হবে ওই পর্যায়ে।’

মিয়ানমার তথাকথিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে সময়ক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহানের। তার মন্তব্য— আন্তর্জাতিভাবে বহুপক্ষীয় চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দেওয়া ত্রাণের জন্য এখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে যাচ্ছে, মিয়ানমারের এমন অভিযোগের বিষয়টি সেমিনারে তুলে ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। তার মতে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান রাশিয়া ও চীনের হাতে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের বিমান বাহিনী পুরোটাই রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া দেশটির বেশিরভাগ আধুনিক সমরাস্ত্র চীন থেকে কেনা।’

বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি সুকমল বড়ুয়া বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যু অনেকে ভুল ব্যাখা করে। এটি মুসলিম বা বৌদ্ধ সংঘাত নয়। এটি মিয়ানমারের জাতীয় সংকট। কোনও কোনও দেশ উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য কৌশলে চেষ্টা করছে।’

রোহিঙ্গা সমস্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়— ‘কোনও ধরনের আগ্রাসী পদক্ষেপ নয়, মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা হবে। বাংলাদেশের মাটি কখনও মিয়ানমারের বিপক্ষে ব্যবহার হবে না।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় শনিবারের অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ হাইকমিশনের প্রতিনিধি ডেভিট অ্যাসলে, মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি বেল মলার, জার্মান দূতাবাসের প্রতিনিধি মাইকেল চৌথে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঢাকা অফিসের প্রধান র্যারগমেন্ট ও অ্যাকশনের এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। এছাড়াও কথা বলেছেন বিভিন্ন দেশে দায়িত্বে পালন করা সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা।