ইমাম খাইর, সিবিএন
সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের আয়কর দিয়ে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করার অহবান জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল।
তিনি বলেন, আয়কর দেশের উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি। আয়করদাতারা দেশের সম্পদ। আমরা আয়কর না দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উন্নয়ন বঞ্চিত হবে। দেশের উন্নয়নের যাত্রায় নিজেকে শরিক করতে যে যার মতো আয়কর দিতে অভ্যস্ত হই।
কক্সবাজারে ৫ দিনব্যাপী আয়কর মেলার উদ্বোধনী সভায় এমপি কমল প্রধান অতিথির বক্তৃতা করছিলেন।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় শহরের খুরুশকুল সড়ক সংলগ্ন এস.কে টাওয়ারস্থ আয়কর অফিস প্রাঙ্গনে মেলা উদ্বোধন করা হয়। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে ২০১৭ সালের আয়কর মেলার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি। এরপর আয়োজিত সভায় তিনি বক্তব্য রাখেন।
সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি বলেছেন, যখন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয় তখন পাকিস্তানীরা আমরা না খেয়ে থাকব বলে প্রচার করে। কিন্তু অল্প সময়ে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর ১৯৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। মানুষের মাঝে আয়কর প্রদানে সচেতনা বেড়েছে। আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হবে।
কর অঞ্চল-৪ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মুহাম্মদ মফিজ উল্যাহর সভাপতিত্বে আয়কর মেলার প্রথম দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন আশেক উল্লাহ রফিক এমপি, জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন, কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম রহিমুল্লাহ, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল কুদ্দুস, কক্সবাজার কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট ছৈয়দুল হক। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সহকারী কর কমিশনার জ্ঞানেন্দ্র বিকাশ চাকমা।এর আগে মেলায় আগত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বরণ করেন কক্সবাজার আয়কর অফিসের সহকারী কর কমিশনার মোঃ জাকারিয়া হোসেন, ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আমান উল্লাহ, গোলাম কিবরিয়াসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন। অতিথিদের সারিবদ্ধ হয়ে অভ্যর্থনা জানায় কক্সবাজার শহরের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
কক্সবাজার আয়কর অফিসের সহকারী কর কমিশনার মোঃ জাকারিয়া হোসেন জানান, ৫ নভেম্বর পর্যন্ত (চার দিন) মেলা চলবে কক্সবাজার সার্কেল-৮৪, ৮৫ ও ৮৬ তে। ৫ নভেম্বর সার্কেল-৮৭ টেকনাফ ও রামু উপজেলায়। ৬ নভেম্বর সার্কেল-৮৮ চকরিয়াতে আয়কর মেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলায় তথ্য সেবা প্রদান, আয়কর রিটার্ন পূরণে সহায়তা, কর প্রদানের জন্য চালান সরবরাহ, আয়কর রিটার্ন গ্রহণ, ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন/রি-রেজিস্ট্রেশন এবং আনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের নির্দেশনা প্রদান করা হবে। তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল পর্যন্ত করদাতা ও সর্ব সাধারণের জন্য মেলা উম্মুক্ত থাকবে।
এদিকে কক্সবাজার আয়কর অফিসের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৬-২০১৭ অর্থ সালে ১০১৮৯ রিটার্নের বিপরীতে ৭৪ কোটি ৪ লাখ টাকা আয়কর আদায় হয়েছে। যা গেল গেল অর্থ বছরের চেয়ে প্রায় ৯ কোটি টাকা বেশী। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। জেলায় মোট করদাতা সংখ্যা ১৭ হাজার ৬২২ জন।
২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে কর অঞ্চল-৪ এর অন্তর্ভুক্ত কক্সবাজার এর ৫টি সার্কেলে মোট আয়কর আদায় হয়েছিল ৬৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। ওই বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। এর আগের অর্থ বছর ৪২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয়কর আদায় হয় ৪৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মূলতঃ করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিন দিন আয়কর আদায় বাড়ছে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিদর্শী রেঞ্জ-৪ (কক্সবাজার) ৫টি সার্কেলের মধ্যে সার্কেল-৮৪, ৮৫ ও ৮৬ (বৈতনিক শাখা) কক্সবাজার শহরের খুরুশকুল রোড় সংলগ্ন এস.কে টাওয়ারে। সার্কেল-৮৭ টেকনাফের বিজিবি রোড়স্থ জাকারিয়া ম্যানশনে এবং সার্কেল-৮৮ চকরিয়া থানা রোড় এলাকার প্রমিলা ভবনে অবস্থিত।

এদিকে ২০১৭ সালে নতুন আয়কর আইন পাস হওয়ার কথা থাকলেও ‍তা এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে আইনটি পাস হবে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আইনটি পাসের জন্য এক বছর পেছানোর কথা জানিয়েছিলেন। তবে কেন এক বছর পেছানো হয়েছে তা স্পষ্ট করেননি।
এনবিআর সূত্র বলছে, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। ফলে প্রস্তাবিত খসড়া পর্যালোচনা করে নতুন খসড়া তৈরিতে সময় লাগছে। তাই এক বছর পেছানো হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যক্ষ কর আইনের খসড়া অনেক দিন ধরেই ওয়েবসাইটে আছে এবং এ বছর আইনটি পাসের উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল। তবে আইনটি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাস হবে’।
সূত্র জানায়, বর্তমান আয়কর ব্যবস্থা আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে আয়কর অধ্যাদেশটি বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ।
আয়কর অধ্যাদেশ জটিল ও যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অনেক আগে থেকে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করে আসছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
২০১২ সালে আইএমএফ’র পরামর্শ ও অর্থায়নে নতুন আয়কর আইন, ২০১২ এর খসড়া তৈরি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ তে ২৪২টি ধারা ও ২৩টি অধ্যায় রয়েছে। খসড়া আইনে অধ্যায় অর্ধেকে করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটি মতামতের জন্য এনবিআরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়।
কিন্তু আইনটি ভারতের আয়কর আইনের হুবহু কপি ও আয়কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে এমন অভিযোগ করে কর্মকর্তারা খসড়া সংশোধনের প্রস্তাব করেন।
অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আইনটি পাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কর্মকর্তাদের এ বিরোধিতার মুখে তা আবারও এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, খসড়া আইনটি পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী করতে সাতজন কর কমিশনারের সমন্বয়ে সাতটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে।

আয়কর বিশেষ অর্থে আয় থেকে কর । সরকারি, বেসরকারি, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান এর কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের উপর সাধারণত আয়কর আরোপ করা হয় বিধিসম্মত নিয়মে। আয়কর হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস সরকারি অর্থায়ন এর ক্ষেত্রে। সাধারণ অর্থে যাদের উপর কর আরোপ করা হয় তাদেরকে বলা হয় করদাতা । প্রত্যক্ষ কর সাধারণত ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করা হয়। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর অধ্যায় ১ থেকে ২৩ পর্যন্ত আয়কর আইন এবং প্রয়োগ এর বিস্তারিত রয়েছে। যেখানে অণুচ্ছেদ সংখ্যা রয়েছে ১৮৭ টি।

> যাদের আয় করমুক্ত আয়সীমার মধ‌্যে নয়, তাদের সবাইকে হিসাব দিতে হবে।
>> মাসিক মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা বা তার বেশি হলে করদাতা সনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) থাকা এবং বার্ষিক আয়কর বিবরণী দেওয়া বাধ‌্যতামূলক।
>> আগের তিন বছরের আয় করযোগ‌্য হয়ে থাকলে এবারও রিটার্ন দিতে হবে।
>> যাদের ব‌্যবসা বা পেশা পরিচালনার জন‌্য ট্রেড লাইসেন্স এবং ব‌্যাংক অ‌্যাকাউন্ট আছে, তাদেরও বিবরণী দাখিল করতে হবে।
>> সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী সকল ব‌্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন দাখিল বাধ‌্যতামূলক
>> এনজিও ব‌্যুরোতে নিবন্ধিত সব এনজিওকে তাদের বার্ষিক আয়-ব‌্যয়ের হিসাব দিতে হবে।
>> ডাক্তার, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, আয়কর আইনজীবী, চাটার্ড অ‌্যাকাউন্টেন্ট, কস্ট ম‌্যানেজমেন্ট অ‌্যাকাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী, স্থাপতি, সার্ভেয়ার অথবা এ ধরনের পেশায় নিয়োজিত সকল ব‌্যক্তিকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
>> চেম্বার অব কমার্স অ‌্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অথবা ট্রেড অ‌্যাসোসিয়েশনের সব সদস‌্যের আয়কর বিবরণী দাখিল বাধ‌্যতামূলক।
>> সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, বিভাগীয় শহর অথবা জেলা শহরে বসবাসকারী কেউ গাড়ির মালিক হলে অথবা মূল‌্য সংযোগ কর আইনে নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস‌্য হলে তাকেও রিটার্ন দিতে হবে।
>> পৌরসভা, সিটি করপোরেশন অথবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রার্থীকে তাদের হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হবে।

এনবিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কর দিবসের, অর্থাৎ ৩০ নভেম্বরের মধ‌্যে আয়কর রিটার্ন দিতে ব‌্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর বছরে করদাতার মোট আয়ের উপর নিরূপিত কর এবং উৎসে করসহ অগ্রিম করের পার্থক‌্যের ওপর মাসিক ২ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ দিতে হবে।
কার জন‌্য কত কর:
# বর্তমান নিয়মে কোনো করদাতার বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি হলে কর দিতে হয়। আর নারী এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। করদাতা প্রতিবন্ধী হলে তাকে পৌনে চার লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে।
# গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা সোয়া চার লাখ টাকা। এ ছাড়া সন্তান প্রতিবন্ধী হলে পিতামাতা ও আইনানুগ অভিভাবক করদাতা হলে বার্ষিক আয়ে আরও ২৫ হাজার টাকা করমুক্ত সুবিধা পাবেন।
# করমুক্ত সীমার বেশি আয় হলে বিভিন্ন হারে কর দিতে হবে। করমুক্ত আয়সীমার পর প্রথম ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে; পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ; পরবর্তী ৬ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ; পরবর্তী ৩০ লাখ টাকার জন্য ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
# এ ছাড়া কোনো ব্যক্তির মোট আয় যদি সাড়ে ৪৭ লাখ টাকার বেশি হয়; তবে বাকি টাকার জন্য ৩০ শতাংশ হারে কর বসবে।
# ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসরত করদাতার জন্য ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা। অন্য সিটি এলাকার জন্য ৪ হাজার টাকা। আর এর বাইরের এলাকার জন্য ৩ হাজার টাকা।