সৈয়দ মোহাম্মদ শাকিল :
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটির পর একটি সমস্যায় জর্জরিত। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দ্রুত সাড়া দিয়েছে সরকার। তাদের আশ্রয় ও মানবিক সাহায্য দেয়া চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকরা যেভাবে রোহিঙ্গা সংকটে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা ঘটনা। বাংলাদেশ সরকারের উদারতা ও জনগনের মানবিকতায় ভাল আছে রোহিঙ্গা গোষ্ঠি। তাদের খুশির যেন সিমা নেই।
বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করছে। রোহিঙ্গাদের চোঁখে মুখে ফুটে উঠছে সে চিত্র। বর্বরতার ছাপ মুছে দেখা যাচ্ছে হাসির ঝিলিক।
রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে মেগা প্রকল্পও রয়েছে। রোহিঙ্গাদেও জন্য খাদ্য নিশ্চিত করণ, বাসস্থান, বস্ত্র, চিকিৎসা সেবা, ল্যাট্রিন, টিউবয়েল, মাতৃসেবা, শিশু পল্লী, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ ত্রাণ কর্যক্রম চলমান রখেছে সরকার।
এ ছাড়াও সকল কার্যক্রমসহ রোহিঙ্গাদের সার্বিক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছে সরকার।
গত ২৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পুশ করতে শুরু করেছে। মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্য থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায় অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যা, নির্যাতন, বর্বরতা, ধর্ষণ থেকে শিশুরা পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। চলছে বার্মা সরকারের নিরাপত্তাকর্মী দ্বারা নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন। প্রাণে বাঁচতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। নৌকাডুবিতে অনেক শিশু, নারী মারা গেছে। এ পর্যন্ত ১২ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এটি দেশের জন্য ভয়াবহ সংকটের।
কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বেশ ভাল আছেন। সরকারসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বস্থরের মানুষ রোহিঙ্গাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। চলমান রোহিঙ্গা সংকটে দুই মাসের অধিক সময় আশ্রিত বিশাল জনগোষ্ঠি রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী নতুন করে দমন অভিযান শুরু করলে ২৫ অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। এর বাইরে আরও প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা গত কযেক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। যাঁরা আসছেন তাঁদের বড় অংশই নারী ও শিশু। রোহিঙ্গারা এখনো আসছেন প্রতিদিন। তবে প্রবেশ পথ পরিবর্তন করেছেন তাঁরা। এখন টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ থেকে নৌকায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। গত চার দিনে ওই পথে প্রায় পঞ্চাশ হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু কক্সবাজারে প্রবেশ করেছে।
আত্মীয়দের ডাকে নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের আশ্বাস পেয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসছেন অনেক রোহিঙ্গা। সেনারা অনেক গ্রাম অবরুদ্ধ করে রাখায় কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে তাদের মজুদ করা খাবার শেষ হয়ে যায়। তারা জানতে পারেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাবার দেয়া হচ্ছে। তাই খাবারের আশায় টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসছেন তারা।
কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিতে কার্যকর উদ্যোগ নেই। বরং এখনো অনেক রোহিঙ্গা কৌশলে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।
মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হেয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার জন্য মেঘা উদ্বাস্ত শিবির বানানো কাজ চলমান রয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্থান দেয়ার জন্য কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শরণার্থী’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাজ এগিয়ে চলছে। ধীরে ধীরে কক্সবাজারের অন্যান্য শরণার্থী ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। “কুতুপালং ক্যাম্পের বাইরে যেসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা থাকছেন ক্রমান্বয়ে তা গুটিয়ে একই ক্যাম্পে সবাইকে রাখা হবে। সবাইকে কুতুপালং ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিদেশী অর্থায়নে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। আধুনিক শেড নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যন্ত বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬৯ জন।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এখনো আধুনিক শেড নির্মাণ না হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাহাড় ধসের পাশাপাশি হাতির আক্রমণের আতঙ্কে দিন কাটছে উখিয়ার কতুপালং এলাকার লাখ লাখ রোহিঙ্গার। সাগরে নিন্মচাপের কারণে তীব্র বাতাসে এমনিতেই পলিথিনের ছাপড়াগুলো দুলছে, তার সাথে হাতির আক্রমণে মারা গেছে বেশক’জন রোহিঙ্গা। এ অবস্থায় সরকার নির্দেশিত ১৪ হাজার শেডের নির্মাণ কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছে প্রশাসন।
তবে, বাংলাদেশে তাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকটের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপের প্রভাব স্থানীয়ভাবে এখনই দেখা যাচ্ছে। কক্সবাজার এলকায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তাদের থাকার জন্য বন এবং পাহাড় কাটা হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে এখন রোহিঙ্গা বেশি। তাদের সঙ্গে কালচারের পার্থক্য আছে। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা এখানে আরো বাড়বে। আমরা বিষয়টি মানবিকভাবেই দেখছি। কিন্তু দীর্ঘ অবস্থানের কারণে সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সিমান্তের নাফ নদী। কয়েকদিন আগেও হাজার হাজার নৌকা নিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতার জন্য বন্ধ রয়েছে মাছ শিকার। ফলে ঘাটে নৌঙ্গর করা আছে শত শত নৌকা।
জেলেরা বেড়িবাঁধের উপর বসে অলস সময় পার করছেন, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তাদের অভিযোগ সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও তাদের হাতে পৌছায়নি।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশেরও কিছু জঙ্গি সংগঠনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে, দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এরা সমর্থন পেয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে- এসব অভিযোগ পুরনো। আবার দেশের ভেতরে জঙ্গি হামলার সঙ্গেও রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে জানা গেছে।
যতই দিন যাচ্ছে ততই অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ বিস্তারের ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কথিত ‘মানবিক সাহায্যে’র অন্তরালে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও এনজিওগুলো বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে।
কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি পুলিশ ভেরিফিকেশনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে আগে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিভাগকে ঝুঁকির মধ্যে রাখা হলেও এখন রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় সবগুলো বিভাগকেই ঝুঁকি হিসাবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়।
সদ্য অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে উখিয়া-টেকনাফের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমিতে। তারা বনভূমিতে বসবাসের পাশাপশি গাছ-বাঁশ কেটে তৈরী করছে ঘর-বাড়ি। আর কাঠ ব্যবহার করছে জ্বালানীর কাজে। এতে উজাড় হচ্ছে উখিয়া-টেকনাফের বনাঞ্চল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে উখিয়া টেকনাফ থেকে হারিয়ে যাবে বনভূমি। মুছে যাবে সবুজ। বনভূমির দেওয়া তথ্যে জানা য়ায়, দৈনিক ৫ লক্ষ কেজি জ্বালানি কাঠ পোড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা।
নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দেশীয় মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। স্থানীয় বাজার থেকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ছাড়াই সংগ্রহ করা হচ্ছে এসব সিম। ফলে ক্যাম্পে সরকারিভাবে টেলিটকের বুথ স্থাপন হলেও তাতে সাড়া দিচ্ছেনা রোহিঙ্গারা। বিষয়টিকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
উম্মুক্ত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দালালের হাত ধরে প্রতি নিয়ত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে যাতায়াতের খবর পাওয়া গেছে। এসব যাতায়াতকারীদের কিছু কিছু সেখানে থেকে গেলেও কারও কারও নিখোঁজের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
গত তিন দশক ধরে ব্যাপক রোহিঙ্গা অবস্থানের কারণে নানা দুর্ভোগ এবং ভোগান্তির শিকার স্থানীয় জনগণ। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি শুরু হয়েছে ২৫ আগষ্টের পর থেকে রোহিঙ্গা ঢলে।
ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাজমা বেগম বলেন, আমরা কল্পনাই করিনি আপনারা আমাদের এতো কিছু করবেন। নিজের দেশেই নিজেরা কিছিু পাইনি অন্য দেশে এতা কিছু পাবো আশাই করিনি।
রোহিঙ্গা যুবক করিম বলেন, আমাদের দেশ আর্মিরা আমাদেরকে চরম নির্যাতন করে। কিন্তু আপনাদের দেশের আর্মিরা অনেক ভালো।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত কিশোরি নাইমা বলেন, প্রথমে বাংলাদেশে আসতে চরম ভয় লেগেছে। তারপরেও জান বাঁচাতে না এসে উপায় ছিলনা। এখানে এসে দেখছি ভয়ের কিছু নেই। আপনারা অনেক ভাল। সব সময় আমাদের খোঁজ নিতে অনেক মানুষ আসে।
বৃদ্ধ রোহিঙ্গা নাজিম বলেন, আমরা বাংলাদেশে অনেক ভাল আছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের অনেক দিয়েছেন। আমার আর কিছু চাইনা। এবার শান্তিতে মরতে পারলেই হলো।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ড.বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যে বর্বর হত্যা নির্যাতন হয়েছে সেটা পৃথীবির সকল মানবিকতাকে হার মানিয়েছে। চুডান্ত মানবাধিকার লংঘন করেছে এবং এখনো করে চলেছে। সেই মুহুর্তে মানিবকতার কারনে বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে নন্দিত হয়েছে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার কারনে পর্যটন নগরী কক্সবাজার সহ সারা দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। ইতি মধ্যে জেলার বনভুমি বিরান হয়ে গেছে,সবুজ নাগরি আর নেই। মারামারি হানাহানি শুরু হয়ে গেছে।
‘অনুপ্রবেশের সময় সাথে আনছে ইয়াবা। সাধারন রোহিঙ্গার সাথে মিশে প্রবেশ করছে জঙ্গি গোষ্ঠী আরসার সদস্যরা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সহযোগীতার নামে উখিয়া-টেকনাফে দেশী বিদেশী অপশক্তিগুলো মিলছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, যততত্র মলমূত্র ত্যাগ করে কক্সবাজারের পরিবেশকে ধ্বংস করছে অনুগ্রবেশকারী গোষ্ঠীটি। তাদের কারণেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশচুম্বী দাম, জেলা জুড়ে জানযট সহ পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। ৬ লক্ষের কাছাকাছি অনুপ্রবেশকারী এই জনগোষ্ঠীর কারণে স্থানীয়রা বঞ্চিত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা থেকে, পাচ্ছে না প্রশাসনের দৈন্দনিন সেবা। সময়ের পরিবর্তণে শ্রম বাজারেও রোহিঙ্গাদের আধিক্য। এদের কারণে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এককথায় কক্সবাজারকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের বর্বরতার ছাপ মুছে হাসির ঝিলিক
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
