ডেস্ক নিউজ:
উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জেরে চলমান সেনা অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঢল বাংলাদেশে আসছে। ২৫ আগস্ট নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার এক মাসের বেশি সময় পর মিয়ানমার সরকার রাখাইনের নিরাপত্তা ও অবকাঠামো উন্নয়নে কয়েক বিলিয়ন কিয়াট প্রকল্পের উদ্বোধন করেছে।

বুধবার দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার এক প্রতিবেদনে বিলিয়ন কিয়াট প্রকল্প উদ্বোধনের তথ্য জানিয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় রাখাইনের ‘দ্য মেইয়ু মাউন্টেইন রেঞ্জ প্রজেক্ট’ শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে বলে ঘোষণা দেয়।

রাখাইনের রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভাষণের পরদিনই এই ঘোষণা আসে। এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭৩ কিলোমিটার সীমান্তে মেরামত এবং নতুন করে বেড়া নির্মাণ। তবে ইতোমধ্যে ২১০ কিলোমিটার সীমান্ত বেড়া নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

rakhine

মিয়ানমার সরকার বলছে, বঙ্গোপসাগর লাগোয়া রাথেডং, মংডু ও বুথিডংয়ের ঘন বনাঞ্চলের অবশিষ্ট ৬৭ কিলোমিটার সীমান্ত অনতিবিলম্বে নির্মাণ করা হবে।

রাখাইনের বিশাল এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক ২০ বিলিয়ন কিয়াট (এক কোটি ৪০ লাখ ৬৪ হাজার মার্কিন ডলার) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মেইয়ু পর্বতাঞ্চলের বিভিন্ন সড়ক মেরামতও এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পর্বত মেইয়ু উপদ্বীপকে উত্তরে মংডু এবং বুথিডং, দক্ষিণে মংডু এবং রাথেডংকে পৃথক করেছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলছে, ‘পর্বতে তারা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরসার আস্তানার খোঁজ পেয়েছে; যেখানে ম্রো, দেইংনেত ও মারামাগয়ির মতো জাতিগত রাখাইন উপ-জাতিদের বসবাস রয়েছে।’

রাখাইনের বিভিন্ন সড়ক মেরামত করে মহাসড়কে রূপান্তর করার তথ্য জানালেও নির্দিষ্ট এলাকার তথ্য জানায়নি কর্তৃপক্ষ। ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার বলছে, ‘মেইয়ু পর্বতের পশ্চিমাঞ্চলের রাথেডং ও মংডু শহরের আশপাশের এলাকা এই প্রকল্পে গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাথেডংয়ের মহাসড়কটি হবে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। রাথেডংয়ের আনগুমাও গ্রাম থেকে শুরু হয়ে মংডুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। এই সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হলে রাখাইনের রাজধানী সিত্তের সঙ্গে মংডুর ও সীমান্ত এলাকার যাতায়াতের সময় নাটকীয়ভাবে কমে আসবে।

rakhine

সিত্তে থেকে মংডু পৌঁছাতে বর্তমানে ৯০ মিনিট পর্বত পাড়ি দেয়ার পর নৌপথে আরও পাঁচ ঘণ্টা ৫০ মিনিট সময় লাগে। এছাড়া সড়ক মেরামতের কাজ শেষ হলে ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে রাখাইনের সিত্তে থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্তে পৌঁছাতে সময় লাগবে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নাটকীয় প্রভাব ফেলবে এটি। মংডু ও বুথিডংয়ের পর্বত সড়কও মিয়ানমার সরকারের নতুন এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তাবেষ্টিত সড়কটি অ্যামফেটামিনের মতো অবৈধ মাদক চোরাচালানের অন্যতম প্রধান রুট।

গত ১ অক্টোবর বার্তাসংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে জানায়, মংডুতে সামরিক একটি গাড়ি থেকে ২০ লাখ মেটামফেটামিন পিলসহ দুই সেনা সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর দেশটির প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৯-১০ ও ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে সীমান্ত বেড়া নির্মাণ প্রকল্পের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ১৯০ বিলিয়ন কিয়াটের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও এর আগের সেনা সরকার কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ও ব্যয় করেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সীমান্ত বেড়া নির্মাণ, উন্নয়ন অথবা মেরামতের জন্য আরও ২০ বিলিয়ন কিয়াট অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হবে। নতুন এই বরাদ্দের মধ্যে আট বিলিয়ন কিয়াট দেয়া হবে চলতি অর্থ-বছরেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই অর্থ যাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে।’

rakhine

সীমান্ত সুরক্ষায় বেড়া নির্মাণ প্রকল্পে দেশটির বেসরকারি বেশকিছু দাতব্য সংস্থা অর্থায়ন করেছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ম্যাক্স মিয়ানমার আয়েয়রাবতি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সীমান্তে দুই কিলোমিটার সীমান্ত নির্মাণের জন্য সোয়া বিলিয়ন কিয়াট অর্থ সেনাবাহিনীকে দেয়। ১৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেত্রী অং সান সু চি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে যাচাই-বাছাইয়ের পর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়া হবে বলে জানান। যদি এই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হয় তাহলে সেখানে পৌঁছানোর পর তারা প্রথমেই আবাসন সঙ্কটে পড়বেন। কারণ স্যাটেলাইটে সংগৃহীত ছবিতে দেখা যায়, গত ২৫ আগস্টের পর রাখাইনের প্রায় ২০০ মুসলিম গ্রামে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব গ্রামের অধিকাংশই মংডুর আনগুমাও, টংপিও সড়কের পাশের। ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্প অথবা সড়ক নির্মাণ এবং মেরামতের কাজ চলমান থাকায় উত্তেজনা আবারও বাড়িয়ে দিতে পারে।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে প্রাণঘাতী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সহিংসতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়েছে। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন প্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও রোহিঙ্গা মুসলিমরা পালাচ্ছেন।

হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের নিন্দা জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে মিয়ানমার জাতিগত নিধনের চেষ্টা করছে মন্তব্য করে সংস্থাটি বলছে, এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

সূত্র : দ্য ইরাবতি, এএফপি, রয়টার্স।