ডেস্ক নিউজ:
মিয়ানমার সরকার ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা ‘আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করার কৌশল’ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

তিনি বলেন, মিয়ানমার নিজস্ব যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য প্রত্যাবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা সীমিত করতে পারে। এছাড়া দেশটি নানা অজুহাতে কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিলম্বিত করতে পারে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের নিজস্ব যাচাই প্রক্রিয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ যৌথ যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের সব প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অংশীদার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথা বলেছে বাংলাদেশ।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের নজরদারি ও সহযোগিতা ছাড়া মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রাখা কঠিন হবে। এ লক্ষ্যে তিনি মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার ঢাকায় বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস (বিস) তাদের নিজস্ব মিলনায়তনে ‘রোহিঙ্গা সংকট : বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেন। বিসের চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গোলটেবিলে অপর বক্তারা রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন সম্ভব না হলে কক্সবাজার পর্যটকশূন্য হতে পারে। উখিয়ার জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করাও কঠিন হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিতভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। সু চির এনএলডি সরকার যাতে রাখাইনে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও জীবনযাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ইতিবাচক নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। রাখাইনে এবারের দমন অভিযানে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় এবং ২৮৪টি গ্রাম পোড়ানো হয়েছে।

মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, মিয়ানমারে মূল সমস্যার সমাধান এবং দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে তাদের ফিরিয়ে নেয়া। তিনি বলেন, প্রথম ক্ষেত্রে মূল সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ অন্যান্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অপপ্রচার, ধর্মীয় বিদ্বেষ, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ প্রয়োগ না করলে মিয়ানমার মূল সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে বলে মনে হয় না। নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তৎপর হতে হবে।
সংকটের দ্বিতীয় অংশে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াকে ‘জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি’ হিসেবে বর্ণনা করেন মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, এ ব্যাপারেও মিয়ানমারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও জীবিকার নিশ্চয়তা না পেলে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা এখন কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়। এটি এখন আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ পেয়েছে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে, বহুপক্ষীয়, আঞ্চলিক, দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ এবার যে নতুন খসড়া চুক্তি মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে তা ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার চেতনা থেকে নেয়া হয়েছে। কফি আনান কমিশনের রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া এবং ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের পর্যালোচনার সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে আনান কমিশনের রিপোর্টের বাস্তবায়নে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে এ ধরনের সংকটের সমাধান দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। ফলে রোহিঙ্গা সংকটও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে তার সমাধানও দীর্ঘমেয়াদে করার প্রয়োজন রয়েছে। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বলে বেড়াচ্ছে যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের লোক। মিয়ানমার কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা বলেছি, এ রিপোর্ট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও শরণার্থী সেলের প্রধান হাবিবুল কবির চৌধুরী বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অল্প সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন সম্ভব না হলে কক্সবাজার পর্যটনশূন্য হওয়ার আশঙ্কা আছে। উখিয়ার স্থানীয় মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা না হলে উখিয়ার স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমানে দেশি ও বিদেশি সূত্র থেকে বিপুল পরিমাণ ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গাদের বিপুল পরিমাণ ত্রাণের চাহিদা কিভাবে মেটানো হবে তা এখনই চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য মুসলিম উম্মাহ বিশেষ করে ওআইসিভুক্ত দেশগুলো থেকে ত্রাণ তেমন পাওয়া যায়নি।