শামসুল হক শারেক ৫২ বছর বয়সে সবার প্রিয় মোখতার চৌধুরী এভাবে চলে যাবেন কেউ কল্পনাও করেনি। হ্যাঁ, সবাইকে চলে যেতে হবে একদিন না একদিন। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এটাই বিধান। ‘কোন প্রাণীর নির্ধারিত সময় (মৃত্যু) এসে গেলে এক সেকেণ্ডও এদিক ওদিক করা হয়না’ (সুরা মুনাফিকুন শেষ আয়াত)। এভাবেই ‘সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত-৫৭)। মোখতার আহমদ চৌধুরী (মোখতার চৌধুরী) আমাদের সমাজের অন্যান্য দশজনের মত একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি কর্মজীবনে ঠিকাদারী বা কন্ট্রাক্টারী করতেন। তিনি কোন জনপ্রতিনিধি বা মেম্বার-চেয়ারম্যান ছিলেন না। সদা হাস্যমূখ নিরহঙ্কারী মোখতার চৌধুরীর সু-সময় দুঃসময় বলতে যেন কিছু ছিলনা। তিনি সবসময় ছিলেন হাসি খুশী উজ্জ্বল চেহারার একজন মানুষ। কিন্তুতিনি যে এত জনপ্রিয় এবং বন্ধু বৎসল ছিলেন তা আমার জানা ছিলনা। তাঁর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের আগ্রহ এবং প্রচণ্ড বৃষ্টি ওপেক্ষা করে তাঁর নামাজে জানাযায় প্রচুর শোকাহত মানুষের উপস্থিতি দেখেই আচঁ করতে পেরেছি তিনি কত জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। মোখতার চৌধুরীর পিতা ছিলেন রাজাপালং ইউনিয়নের একসময়ের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুর সাত্তার মিয়া (সাত্তার মিয়া)। তিনি ছিলেন সাবেক এমপি ও বর্তমান জেলা বিএনপির সভাপতি জনাব শাহজাহান চৌধুরীর (একমাত্র ফুফুর জামাই) ফুফা। সে হিসেবে মোখতার চৌধুরী সম্পর্কে শাহজাহান চৌধুরীর ফুফাত ভাই। মরহুম সাত্তার মিয়ার তিন পুত্র ও ৩ মেয়ের মধ্যে মোখতারচৌধুরী ২য়। বড় ভাই ইউনুচ চৌধুরী ও ছোট ভাই জহির চৌধুরী। মেয়ের জামাইদের মধ্যে একজন ফিরোজ অহমদ (অমিরাবাদ) প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও এড. সোলতানুল আলম এবং এড. খোরশেদ অলম কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। মোখতার চৌধুরীরা শাহজাহান চৌধুরী পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্টজন। জনাব শাহজাহান চৌধুরী ৪বারের এমপি ছিলেন। হুইপ ছিলেন, গণপুর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সুযোগে উখিয়া-টেকনাফে এমপির আওতাধীন প্রায় সকল উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারী আঞ্জাম দিতেন মোখতার চৌধুরী। মোখতার চৌধুরীদের সামনের (উত্তর পাশের) একশত গজ দূরত্বের মাওলানা বদিউজ্জামানের বাড়িটি আমার শ্বশুর বাড়ি। আমার শ্বশুর বাড়ির সাথেসত্তার মিয়া পরিবার ও শাহজাহান চৌধুরী পরিবারের হৃদ্যতাপুর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের এবং পুরানো। তাই এই দুই পরিবারের সদস্যরা আমাকেও তাদেরই আপন বোনের জামাই এর মত আদর স্নেহ করে থাকেন। এই দুই পরিবারের কারো কাছ থেকে আমার প্রতি আদর স্নেহের কোন কমতি আমি কোন দিন দেখিনি। এক্ষেত্রে বলতে হয় মরহুম মোখতার চৌধুরীর আদর স্নেহটা আমার প্রতি যেন একটুবেশীই ছিল। মোখতার ভাই বয়সে আমার ছোট হলেও আমার বউ আয়েশা বেগমের বড়। তাই তাকে আমি বড় ভাই হিসেবে মানতাম। তিনিও আমাকে ছোট বোনের জামাই হিসেবে মনে করে প্রায় সময় খোঁজ খবর রাখতেন। ২০০৫ সালের কোন একদিন হোটেল প্যানোয়ার দৈনিক ইনকিলাব (আমার) অফিসে এসে বলেন, ভাই আপনার জন্য আমি কিছু করতে পারি ? আমি বললাম আমার জন্য দোয়া করলেহবে। তখন বলেন, আমার বোনের জন্য কি করতে পারি ? আপনাদের গ্রামের বাড়ি গয়ালমারায় মূল সড়ক থেকে বাড়িতে যাতায়াতের কাঁচা সড়কটি কত গজ একটু জানান। আমি খবর নিয়ে তাঁকে জানালাম দূরত্বটা ৭/৮শ গজ। তথ্যটি জেনে তিনি হাসিমূখে চলে গেলেন। দু’একদিন পরে আব্বা আলহাজ্ব আসয়াদ আলী জানালেন, আমাদের বাড়ির কাঁচা সড়কটি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। তার পর মোখতার ভাই এর কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেমন কিছু না-বোনের জন্য রাস্তার ওই ছোট কাজটা করে দিচ্ছি। সপ্তাহ দশ দিন পরে গিয়ে দেখি ব্রীক সলিন দিয়ে সড়কটি সুন্দর করে সংস্কার করে দেয়া হয়েছে। মোখতার ভাই এর এই ব্যবহারে সত্যিইআমরা অভিভূত এবং কৃতজ্ঞ। রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ছাড়াও অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা নির্মাণকাজ এবং সামাজিক ও ধর্মীয় কাজের সাথে জড়িত ছিলেন মোখতার চৌধুরী। শিক্ষা-সামাজিক কাজ এবং অভাবী মানুষের প্রয়োজনে দু’হাতে অর্থ খরচ করতেন তিনি। গত ১১ আগষ্ট ২০১৭ ইং সকালে মোখতার ভাই এর মৃত্যুর সংবাদটি ফোনে প্রথমে জানান আমার শ্বাশুড়ি। তাঁর কাছ থেকে জেনে আমার বউ আয়েশা বেগম মোখতার দাদা নাকি মারাগেছে? বলে হাউমাউ করে উঠে। উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরীকে ফোন করে খবরটি নিশ্চিত হই। তিনি জানান, শহরের বইল্যা পাড়ার বাসায় রাতে হার্টএ্যটাক করে তিনি ইন্তেকালকরেছেন। দ্রুত তাকে উখিয়া মধ্য রাজাপালং গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আবুল কাশেম-নূর জাহান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়’ মাঠে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। তখন মনে পড়ে মোখতার ভাইকে নিয়ে আমার আরো কত স্মৃতির কথা। তাছাড়াও সেই (মৃত্যু বরণ করার) রাতে ২টা পর্যন্ত আমি তাঁকে ফেসবুকে সক্রিয় পেয়েছি। সকালে মৃত্যু সংবাদ মাথায় যেনআকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তখন ফেসবুকে দ্রুত মৃত্যু সংবাদটি প্রকাশ করে এবং নামাজে জানাযায় হাজির হয়ে মোখতার ভাই এর জন্য দোয়া কামনা করে একজন মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের হক্ব আদায় করলাম। কাদা ও পানির কারণে আবুল কাশেম-নূর জাহান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাযা হতে পারেনি। পার্শ্ববর্তী মসজিদ সংলগ্ন মাঠে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে সর্বস্তরের হাজারো শোকাহত মানুষের জানাযায় উপস্থিতি প্রমান করে মোখতার চৌধুরী ছিলেন সকলের কাছে একজন প্রিয় মানুষ। এছাড়াও ফেসবুকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে যে পরিমাণ মানুষইতিবাচক মন্তব্য করেছেন তাতেও বুঝাযায় মানুষের হৃদয়ে মোখতার চৌধুরীর কতখানি জায়গা ছিল। জানাযায় তাঁর ছোট ভাই জহির চৌধুরী আমাকে জানান, তিনি (মোখতার ভাই) নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন এবং প্রতি সপ্তাহে রোজা রাখতেন। মৃত্যুর আগের দিন মানে বৃহষ্পতিবারও তিনি রোজা রেখেছেন। বইল্যা পাড়ার বাসায় তিনি একা হওয়ায় সেই রাতে নিজেই সাহরীর জন্য ভাত রান্না করার কথা জানিয়েছিলেন স্ত্রী বেলী (ভাবী) ও জহির ভাইকে। সকালে যারা বাসায় গেছেন তারাদেখেছেন, তিনি রান্না করা ভাতের অর্ধেক খেয়েছেন। পাশে কুরআন শরীফ খোলা ছিল (হয়ত তিনি সাহরী খেয়ে কুরআন শরীফ পড়ছিলেন)। জানাযায় সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, তাঁর পরিবারের অমায়িক ও বিশ্বস্থ একজন ছিলেন মোখতার (চৌধুরী)। তাঁর ইন্তেকালে তাঁদের পরিবারের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এড. শাহজালাল চৌধুরী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মোখতার (চৌধুরী) ছিলেন তাঁর অত্যন্ত আপনজন। অত্যন্ত ধার্মিক ও জনপ্রিয় এবং বিশ্বস্থ। আজ মোখতার চৌধুরী নেই, তাঁর সকল ভাল কাজ গুলো স্মৃতি হয়ে আছে। মহান অল্লাহর কাছে দোয়া করি তাঁর সকল ভাল কাজগুলো কবুল করুন, তাঁর সকল ভুল-ক্রুটিগুলো ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দিন।