বাংলা ট্রিবিউন

জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে এসেছে কক্সবাজারের টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। এরপর তাদের আশ্রয় হয়েছে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে। তবে বান্দরবানের তমব্রু ও চাকডালা সীমান্ত দিয়েও অনেকে এসেছেন। তারা আশ্রয় নিয়েছেন সেখানেই। নিজের দেশ, ঘরবাড়ি ফেলে আসা এসব মানুষ এখনও নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার দীর্ঘ যাত্রার মানসিক বিপর্যস্ততাও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদেই বসতি গড়তে হয়েছে তাদের। বান্দরবানে থাকা রোহিঙ্গাদের এখন টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু বান্দরবানে থাকা রোহিঙ্গারা কুতুপালং ক্যাম্পে যেতে নারাজ। একবার বাস্তুহারা এসব মানুষ নতুন করে উদ্বাস্তু হয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে চান না।

রোহিঙ্গারা বলছেন, বাংলাদেশে আসার আগে মিয়ানমার বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাদের। রাখাইনে থাকতেও তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে। তার ওপর বাংলাদেশে আসার সময় পাহাড়, নদী, জঙ্গল পার হতে হয়েছে। কয়েকদিন ধরে পায়ে হেঁটে যখন বাংলাদেশে তারা পৌঁছেছেন,তখন তাদের অনেকেই শারীরিকভাবে হাঁটা-চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এখানে আসার পর অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘ যাত্রার শারীরিক-মানসিক চাপ তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু সীমান্তের পশ্চিমকূলে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। আর নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের চাকডালা সীমান্তে রয়েছেন আরও প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা। এর মধ্যে এখানকার রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পশ্চিমকূলের ৫০ রোহিঙ্গা পরিবারের ২২১ জনকে কুতুপালং ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পর্যায়ক্রমে এখানকার অন্য রোহিঙ্গাদেরও স্থানান্তর করা হবে কক্সবাজারে। তবে তারা যেতে চান না, এখানেই থেকে যেতে চান।

বান্দরবানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বলছেন, এখানকার পরিবেশের সঙ্গে তারা মাত্র খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছেন। কুতুপালং নিয়ে গেলে আবার তাদের নতুন করে শুরু করতে হবে। সেখানকার পরিবেশে নতুন করে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন— এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।রোহিঙ্গা নারী মাহমুদা খাতুন

পশ্চিমকূলে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মাহমুদা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এখানেই ভালো আছি। আমরা কুতুপালংয়ে যেতে চাই না। মিয়ানমারে এখনও অনেক রোহিঙ্গা আছে, তারাও এখানে এসে আশ্রয় নেবে। নতুন যারা আসবে, সরকার তাদের কুতুপালং নিয়ে গেলেই ভালো হবে।’

মাহমুদা খাতুনের পাশেই ছিলেন মোহাম্মদ নুরু। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে ভালোভাবে থাকতে পারছি, খাওয়া-দাওয়া করতে পারছি। আমাদের তেমন কোনও সমস্যা হচ্ছে না এখানে। তাই এখানেই আমরা থাকতে চাই। অন্য কোথাও যেতে চাই না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকদিন হেঁটে বাংলাদেশে এসেছি। হাঁটাতে হাঁটতে আমাদের পায়ের নিচে চামড়া ফেঁটে গেছে। এখানে কয়েকদিন থাকার পর এখন একটু একটু করে পা ভালো হচ্ছে। এখন আমরা কেউ অন্য কোথাও যেতে চাই না।’

আরেক রোহিঙ্গা আহমদ কবির বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে আসতে আসতে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবাই অসুস্থ। এ অবস্থায় তাদের কুতুপালংয়ে নিয়ে যাওয়াটাই কঠিন হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসার পর আমরা অনেক কষ্ট করে ঘরগুলো তৈরি করেছি। এখন এগুলো ফেলে যেতেও তো খারাপ লাগবে।’

তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য সরকারের উদ্যোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব রোহিঙ্গারা এসেছেন, তাদের জন্য সরকার কক্সবাজারের  উখিয়ার কুতুপালংয়ে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে। যতদিন পর্যন্ত তারা নিজ দেশে ফিরে না যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। তার অংশ হিসেবে বান্দরবানের রোহিঙ্গাদেরও পর্যায়ক্রমে কুতুপালংয়ে স্থানান্তর করা হবে।’

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘বর্তমানে রোহিঙ্গারা জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছেন। এখানে রোহিঙ্গাদের থাকাটা নিরাপদ নয়। যে কোনও মুহূর্তে মিয়ানমারের হামলার ঝুঁকিতে আছেন। তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’ তবে আপাতত সুস্থদেরই কুতুপালং নেওয়া হচ্ছে, অসুস্থদের পরে স্থানান্তর করা হবে বলে জানান তিনি।