অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন :

বুঝতে কস্ট হয় না যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মায়ানমার সরকার ইঁদুর বিড়াল খেলা খেলছে।একদিকে যেমন উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি থেকে তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারছে না। তখন নিজেদের অপরাধগুলোকেও তারা লুকিয়েং রাখতে পারছনা। তখন তারা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বকে শান্ত করে। একসময়ের সমৃদ্ধ অঞ্চল আরাকান এখন ধ্বংস হয়ে গেছে।এখানে কোন ঘর বাড়ী আর নেই। অনেক লোককে মেরে ফেলা হয়েছে । কনসেন্ট্রেশন কেম্পে রাখা হয়েছে। ওখানেই তাদের ধুকে ধুকে মরতে হচ্ছে। বেশীরভাগ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

বুঝতে কস্ট হয়নাযে, বিগত দিনগুলোতে সমঝোতা স্মারকে বেশ কিছু লক্ষণীয় বিষয় আছে, যেমন :- বাংলাদেশের আগত রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে বার্মার নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও স্মারকে lawful Resident of Burma (ল ফুল সিটিজেন অব বার্মা ) না বলে Lawful citizen of Burma (ল ফুল রেসিডেন্ট অব বার্মা) বলা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি পরিস্কার নয়। কেননা, Citizen শব্দের অথর্ রাস্ট্রের নাগরিক, A person who has full rights as a member of a country ,either by birth or by being given such rights.(এ পার্সন হো হেজ ফুল রাইটস এস এ মেমবার অব এ কাট্রি, আইদার বাই বার্থ অর বাই বিং গিবেন সাচ রাইট) পক্ষান্তরে resident (রেসিডেন্ট) হলো বসবাসকারী, বাসিন্দা অর্থাৎ A person who lives or has a home in a place, not a visitor. (এ পার্সন হো লিভস অর হেজ এ হোম ইন এ প্লেস, নট এ ভিজিট্র)। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে খেয়াল করলেও স্বারকে এমন ধরনের শব্দের ব্যবহার ছিল রহস্যজনক। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পাশাপাশি তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯২ সালে ২১ সে মাচর্ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব ভোট্রোস গালী র সংগে সাক্ষাৎ করেন। সে প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দুত , জাতিসংঘ আনডার সেক্রেটারী জান কে এলিয়াসন বার্মা এবং বাংলাদেশে মোট ছয় দিন সফর করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ শে এপ্রিল মায়ানমারের পররাস্ট্র মন্ত্রী উ অন গিয়াও ১৪ জন সদস্য নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকল্পে একটি ত্রি পক্ষিয় চুক্তি সাক্ষরিত হয়।

এখানে উলেখ্য যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রথম পর্যায়ে মিয়ানমারে বসবাসকরা বা নাগরিকত্বের সামান্যতম প্রমাণ থাকলেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত থাকলেও জাতিসংঘকে এব্যাপারে সরাসরিভাবে জড়িত রাখার ব্যাপারে মায়ানমার সরকার রাজী ছিলেন না। ছয়দিন ব্যাপী বেশকয়েক দফা আলোচনা চলে। কিন্তু  স্থায়ী কোন চুক্তির ব্যাপারে মায়ানমার সরকারকে রাজী করানো যায়নি।

বার্মার জেনারেল উ নু ১৯৬০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নে উইন এর নিকট থেকে ক্ষমতা গ্রহণকরে বার্মা ফেডারেশনের অধীনে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ লক্ষে তিনি উত্তর আরাকানের রোহিঙ্গা প্রধান অঞ্চল নিয়ে মেউ ফ্রন্টিয়ার এডমিনিস্ট্রেশন গঠন করেন। আরাকানের মঘ গোষ্টীর নির্যাতন থেকে রক্ষাকরার জন্য মূলত এ ব্যাবস্থা নেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। মগ সম্প্রদায় একে বার্মা সরকারের Divide and Rule (ডিভাইড এন্ড রুল) নীতি বলে অভিহিত করে এবং একে আরাকানের Kala (বিদেশী) রক্ষার উদ্যোগ বলে পরিহাস করে। জেনারেল উনুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গারা অস্ত্র সমর্পন করে ১৯৬১ সালের ৪ টা জুলাই। এতে বার্মার চিফ অব স্টাফ বিগ্রেডিয়ার অং জিং তাঁর বেতার ভাষনে বলেন “রোহিঙ্গারা বার্মার শান্তিপ্রিয় নাগরিক। বার্মা সরকারের তরফ থেকে শুধুমাত্র ভুল বুঝাবুঝির কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতিবহু অন্যায় করা হয়েছে; আজ সে ভুল বুঝাবুঝির অবসানের মাধ্যমে সকল সমস্যা দুরীভুত হয়েছে। তিনি আরো বলেন পৃথিবীর সবসীমান্তে একই জাতি সীমান্তের দুই পারে বাস করেন। এ জন্যে কোন নাগরিকের জাতীয়তা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়।”রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের দৃস্টিভঙ্গী কতটুকু কার্যকর হয়েছে বর্তমানে তাই আমাদের দেখার বিষয়। বাংলাদেশ এবংবমীর্ কতর্পৃ ক্ষ ১৯৭৮ সালের ৯ই জুলাই বাংলাদেশে থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়ে রাস্ট্রিয় ভবনে বাংলাদেশ বার্মা এব সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব তোবারক হোসেন ও বার্মার পক্ষে বমীর্ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং উপ পররাষ্ট্র মন্ত্রী টিন অং সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।

কিন্তু এ চুক্তি সাক্ষরের পর পরই রাস্ট্রিয় অতিথিভবন পদ্মায় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের এক প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমারের পররাস্ট্র মন্ত্রী বলেন “রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ ভিত্তিহীন, মুলত গুজবের উপর ভিত্তি করেই তারা দেশত্যাগ করেছে।” এ চুক্তিতে unhcr কে শরণ্ র্াীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী যোগান দেওয়া ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্তিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ২২ আগস্ট চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ওমর ফারুক এবং মিয়ানমারের অভিবাসন ও জনশক্তি বিভাগের ডাইরেক্টর উ মং অং এর নেতৃতে ¡ এক বৈঠক অনুষ্টিত হয়। উক্ত বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আরাকানে সফরের অনুমতি প্রদান করা হয় এবং তাদের চলাচলের উপর বিধিনিষেদ রদ করা হয়। নামাযের সময় মুসল্লীদের মসজিদে মাইক ব্যাবহার করতে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। ইউ এন এইচ সি আর কে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় আছে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের চিন্তাশীল মহলেও চুক্তির ব্যাপারে মত পার্থক্য দেখা গেছে। তাদের মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবসনে বার্মার সঙ্গে বাংলাদেশের কার্যত: ক্নো চুক্তি হয়নি। যদিও সরকারী পর্যায়ে এটাকে চুক্তি হিসেবে ফলাও ভাবে প্রচার করা হচ্ছে। যে ঘোষণাকে চুক্তি বলা হয়েছে এটিকে প্রথমে যৌথ ঘোষনা (joint statement) জয়েন্ট এস্টেটমেন্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন বিষয়ে দুদেশ চুক্তি করলে সেটা পালনে সে বাধ্য থাকে। একাটি অতি গুরুতপুর্র্ণ বিষয়ে দীর্ঘদিন আলাপ আলোচনার পর কেবলমাত্র যৌথঘোষনাকে চুক্তি বলে চালিয়ে দিয়ে সমস্যা সমাধান আদৌ হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। শরণাথীর্ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের উপর যথেস্ট চাপ সৃস্টি করলেও তাদেরকে রাজি করাতে পারেনি। ১৯৯২ সালে ২৭ শে এপ্রিল সোমবার রাতে দীঘর্ বাক বিতন্ডার পর আলোচনা ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত joint statement (জয়েন্ট এস্টেটমেন্ট) এ রাজি হয়ে সাক্ষর করে।

ঠিক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রৃুপ তৈরীর কথা এবারেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মায়ানমার সরকার বলে গেছেন। উভয়ে সম্মত হয়েছেন। পারস্পরিক সম্প্রীতির কথা কখনো খারাপ নয়। কিন্তু বার্মা সরকারের বিগত ইতিহাস ঘেটে তাদের কর্মকান্ডের খতিয়ান দেখে বাংলাদেশকে এগোতে হবে বলে আমি মনে করি। আগেই বলেছি তারা চুক্তি বলুন বাই লেটারাল চুক্তি বলুন অনেক ব্যাপারে কোন নতজানু চরিত্রের ছিলনা। একটু আন্তর্জাতিক চাপ পড়লেই জয়েন্ট এগ্রিমেন্ট ইত্যাদী বলে কালক্ষেপন করা তাদের অভ্যাস। যেমন; গতবারে অর্থাৎ ১৯৯৪ – ৯৫ সালের ১২০০ জন রিফিউজির ক্লিয়ার কেস অর্থাৎ তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই এরকম কাগজ বুড়ো প্রজাপতির মতো মুখ থুবড়ে ইউ এন এইচ সি আর এর তাকে পড়ে আছে।তাদের ব্যাপারে মায়ানমার সরকার কিছু করেছে কি? আরো ব্যাপার হলো জয়েন্টে ওয়ার্কিং গ্রুপ করলাম উভয় দেশের প্রতিনিধি থাকবে । যেখানে বাস্তব নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা মায়ানমারের উচ্চ প্রতিনিধি অস্বীকার করে চলেছেন, সেখানে কাগজ পত্র বিহীন হাজার হাজার রিফিউজি শতবার চিল্লাচিল্লি করে গলা ফাটালে তারা স্বীকার করবে কি? হয়তো রিফিউজি বলবে আমি অমুক জায়গার মানুষ আমার বাড়ী অমুক জায়গায় । কিন্তু কাগজ পত্রতো ঘরপুড়ার সময় হারিয়ে গেছে। কিংবা বর্মী বাহিনী কেড়ে নিয়েছে। সেই কাগজ পত্র দেখাবে কিভাবে? এভাবে দীর্ঘসুত্রিতার সৃস্টি হবে। আপনারাই ভাবুন গতবারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কত শ্লথ গতিতে হয়েছে ।শুধু মাত্র বার্মা সরকারের অনমনীয় সিদ্ধান্তের ফলে। ১৯৯৫ সালে হেড কাউন্ড জরীপে প্রায় ৮ ১০ পাতার ইন্টারভিউ রিফিউজি থেকে নেওয়া হয়েছিল। আমার মনে হয় এযাবত যত ইন্টারভিউ হয়েছে এটিই সব চেয়ে পারফেক্ট। প্রায় বিশ হাজার এর চেয়ে কিছু বেশী রিফিউজির ইন্টারভিউ (আই এফ কিউ) নেওয়া হয়েছিল । এই ইন্টারভিউ টি প্রায় আট থেকে দশ পাতার মতো হবে।তাদের ছবি সহ সব ডাটা তৈরী করে আলমীরাতে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে ইউ এন এইচ সি আর এর অন্যান্য কার্যক্রমে তা ভেস্তে গেছে। তারা তাদের প্রয়োজনে অনেক জরীপ করে থাকেন। তা সত্যি। এভাবে খেলারাম খেলে যা নীতিতে দীর্ঘসুত্রিতার পরিচয় মেলে। এটি কোনক্রমে বাংলাদেশের জন্য ভালো নয়।

যাহোক , এখন যেভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ,তা অত্যান্ত ফলপ্রসু হয়েছে। আমার মনে হয় যাবতীয় এনজিও দের কার্যক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দারা নিয়ন্ত্রন হওয়া উচিত। তাহলে কালক্ষেপন হবেনা বলে আমার বিশ্বাস। কারন অতীতে দেখা গেছে ফান্ড নেই। ইউ এন এইচ সি আর কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে চাচ্ছে, ইত্যাদী কথা আমরা অনেক শুনেছি।