রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী-শিশু পাচারকারী সিন্ডিকেট সক্রিয়

হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা এবার ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় করে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ পাড়ি দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এতে দুর্ঘটনার আশংকা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রাতের আঁধারে নাফনদী পাড়ি দিচ্ছে বলেও জানা গেছে। এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, গত কয়েক দিন ধরে শাহপরীরদ্বীপ থেকে কোন ফিশিং ট্রলার মিয়ানমারের উপকুলে রোহিঙ্গা পরিবহনের জন্য যাতায়ত করেনি। ওপারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্ত বড় ফিশিং ট্রলার না পেয়ে নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ছোট নৌকায় করে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ পাড়ি দিচ্ছে। শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দা মাষ্টার জাহেদ হোসেন বলেন ‘হঠাৎ করে এখন রাতের আঁধারে ছোট ছোট নৌকায় করে মিয়ানমারের মংডু শহরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারী, পুরুষ ও শিশুরা পালিয়ে আসছেন। এখন যারা আসছেন তারা মালামালও সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গারা সঙ্গে সৌর বিদ্যুৎ এর সোলার প্যানেল সাথে নিয়ে আসছে’। শাহপরীরদ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন ‘রোহিঙ্গারা প্রথম দিকে দিনের বেলায় অনুপ্রবেশ করত। কিন্তু এখন রাতের আধাঁরে নাফনদী অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা আসছে। ছোট ছোট নৌকায় করে সন্ধ্যার পর পরই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার হিড়িক পড়ে’।

সরেজমিন সোমবার দিবাগত রাত ৮টার দিকে দেখা যায়, শাহপরীরদ্বীপ জেটির পূর্ব পাশে একটি ছোট নৌকায় করে ২১ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিয়ে কাঠের তৈরী নৌকা কূলে ভিড়ানো হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন নারী ও শিশুর কান্না দূর থেকে ভেসে আসে। তখন ৪ জন বিজিবির সদস্য ও ২ জন সাংবাদিক একটু সামনে গিয়ে দেখা যায় ভয়ে কাঁপছে শিশু ও নারীরা। এরমধ্যে আরও ৭টি নৌকা এসে হাজির। নৌকাগুলোকে ৩০ থেকে ৫০ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। এভাবে রাত ১১টা পর্যন্ত ৪৭টি নৌকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। ওই সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা তাদের আতœীয়-স্বজন এবং স্থানীয় কিছু লোকজন রোগিঙ্গাদের নৌকা থেকে নামিয়ে আনতে দেখা যায়। পরে তাদের বেড়িবাঁধের উপর জড়ো করা হয়। পরে সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় শাহপরীরদ্বীপ দারুল উলুম মাদ্রাসায়। সেখানে বিভিন্ন কক্ষে নারী ও পুরুষকে ভাগ করে রাখা হয়। একটি গরু জবাই করা হয় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য। পরে রাতভর চলে রান্নার কাজ। সকালে রোহিঙ্গাদের প্যাকেট করে প্রতিজনের হাতে দেওয়া হয় খাবার। এসময় কিছু লোক রোহিঙ্গাদের হাতে টাকা দিতে দেখা যায়।

নৌকার মাঝি রোহিঙ্গা রহমত উল্লাহ বলেন ‘প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের নৌকায় করে নাফনদী পারাপার করে আসছি। মিয়ানমার পুলিশ (বিজিপি) আমাকে কিছু করেনা। প্রতি টিপে তাদেরকে ৫০ হাজার কায়াট দিয়ে থাকি। ওপার থেকে এপারে আসতে ১ ঘণ্টা সময় লাগে। মংডু থেকে বুচিডংয়ের দুরত্ব ২০ কিলোমিটারের মতো। সেখানে ৩২০টির মতো গ্রাম রয়েছে। এসব গ্রামে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস। আগস্টের শেষের দিক থেকে রোহিঙ্গাদের চলে আসা শুরু হলেও টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল যারা তাদেরও এখন চলে আসতে হচ্ছে। কেননা গত এক মাস ধরে এলাকার লোকজনকে চলাফেলা করতে দিচ্ছে না। ফলে সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে’।

মিয়ানমারের মংডুর খইল্যাভাঙ্গা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নবী হোসেন, আজিজুল রহমান ও আহমদ আলী বলেন ‘জীবন বাচাঁতে এখানে পালিয়ে এসেছি। সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুঁড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামে কোন রোহিঙ্গাদের থাকাতে দিচ্ছেনা। ভালো কাঠের তৈরি ঘরগুলো দখল করে নিচ্ছে। দিনের বেলায় প্যারাবনের পাশে নৌকার মাঝিদের ঘরে অবস্থান নিতে হচ্ছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর নৌকায় করে নাফনদী পাড়ি দিতে হচ্ছে রাতের আধাঁরে। এমন সময় নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটলে প্রচুর লোক মারা যাবে’। তারা আরও বলেন ‘সেনা সদস্যরা মুসলিমদের ঘরবাড়ি দখল করছে। এসব থেকে রক্ষা পেতে অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। পালিয়ে আসা ব্যবসায়ীদের গরু-শুটকি, আচারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বাড়ি রক্ষা করতে আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে ১৩ কোটি কিয়েট দিতে হয়েছে। এরপর কি হবে আর জানিনা। বাংলাদেশ থেকে বড় বড় ফিশিং ট্রলার যাচ্ছেনা। এদিকে মিয়ানমারে জীবন-যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাই নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি সত্বেও ছোট নৌকায় করে বাংলাদেশে চলে এসেছি’।

সাবরাং ইউপির চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন ‘সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোররাত পর্যন্ত নাফনদী অতিক্রম করে প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো রোহিঙ্গা এসেছে। টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা ছোট ছোট দলে নৌকায় করে রাতের আধাঁরে নাফনদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে।

এদিকে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সহস্রাধিক নারী ও শিশু নিখোঁজের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাম্প এলাকায় মাইকিং করা হয়। ‘নিখোঁজ সংবাদ’ প্রচার করতে মাইকিংসহ কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কেউ হারিয়ে গেলেই কুতুপালং ক্যাম্পে বর্মি ভাষায় মাইকিং করা হয়। নিয়মিত মাইকিং করেন নজির আহমদ নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি বলেন ‘প্রতিদিন অন্তত চার-পাঁচ জন অল্পবয়সী নারী ও শিশুর নিখোঁজের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই সংবাদ আমরা মাইকে প্রচার করছি’। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শুরুর দিকে এই অভিযোগ বেশি থাকলেও এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর নিখোঁজের সংখ্যা অনেকাংশেই কমে গেছে। শিশু ও নারী পাচার রুখতে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে ২৭টি তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ, কোথাও সেনাবাহিনী আবার কোথাও বিজিবি চৌকিতে দায়িত্ব পালন করছে।

জানা যায়, গত এক মাসে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দালাল চক্রের নানা প্রতারণার অভিযোগে ২৫০ জনকে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার ছাড়ার সময় ২৮ হাজার জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ক্যাম্পে। তবে স্রোত নামার দুই সপ্তার মাথায় অন্তত অর্ধলাখ রোহিঙ্গাকে দালাল চক্র বিভিন্ন কৌশলে কক্সবাজার-ছাড়া করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন ‘ছদ্মবেশে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার পথে উখিয়া থানা পুলিশ অন্তত সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। পরে তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে উখিয়া ছাড়তে চেয়েছিল। অনুসন্ধান চালিয়ে ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন পাচারকারীকে আটক করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানান, প্রথম দিকে পাচারকারী চক্র উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচার করার অপকৌশলও নিয়েছিল এই চক্র। কিন্তু প্রশাসন তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি ছদ্মভাবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে এসে যুক্ত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। এখন শিশু ও নারী পাচার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফের অস্থায়ী ক্যাম্পের প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা যুবতী, নারী ও শিশু নিখোঁজ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২০০ জনকে উদ্ধার করে তাদের স্বজনদের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে সহস্রাধিক। উখিয়ার কুতুপালং, টিভি টাওয়ার পাহাড়, বালুখালী, মাইন্যার ঘোনা, তাজনিরমার খোলা, হাকিমপাড়া, থাইংখালী, তেল খোলাসহ অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী-শিশু পাচারকারীদের ঘাঁটি ছিল। চক্রের অনেক সদস্যই ত্রাণ দেওয়ার নামে নামিদামি গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পগুলোয় আসত। সামান্য কিছু ত্রাণ বিতরণের নামে তারা নারী ও শিশু টার্গেট করত। তারা সঙ্গে নিয়ে আসত শাড়ি-গয়নাসহ শিশুদের পোশাক। সুবিধাজনক কোনো স্থান পেলে টার্গেট করা নারী ও শিশুকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ওইসব পোশাক পরাত। এক পর্যায়ে নিজের গাড়ি কিংবা মাইক্রোয় করে তাদের নিয়ে যেত। তবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই চক্রটি এখন ছিটকে পড়েছে। এখন আর কেউ সেভাবে ত্রাণও দিতে পারে না। কোনো প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কাউকে যেতেও দেওয়া হয় না।

বেসরকারী সংস্থা হেলপ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বলেন ‘পাচারকারীরা এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সতর্কতায় তারা পেরে উঠছেনা। এর পরও নিজেদের স্বজন পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজের নামে নারী-শিশু পাচার হচ্ছে’।

পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন ‘ক্যাম্পভিত্তিক পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিনিয়ত মাইকিং করে নিখোঁজদের সন্ধান করছেন অভিভাবকরা। এতে বৃহত্তর রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানীয় অভিভাবকদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে’।

সম্প্রতি বালুখালী তেলিপাড়া অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রিত নার্গিস বেগম (২৫) ও তার ছেলে মো. রবিউল্লাহকে (৮) একটি চক্র প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচারের সময় কুমিল্লার সীমান্তবর্তী জামপুর গ্রাম থেকে তাদের আটক করে বিজিবি। পরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় সাধারণ ডায়েরি করে তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয় মা-ছেলেকে। উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন ‘রোহিঙ্গাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কৌশলে প্রলোভনে ফেলে কিছু অসাধু চক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো ভূমিকার কারণে এই চক্র হাতেনাতে গ্রেফতারও হচ্ছে। এখন অনেকাংশে পাচার কমে এসেছে’।