মনির ইউসুফ :

বিশ্বের প্রত্যেক নিপীড়িত জাতিসত্তার পক্ষে দেশে দেশে কবি সাহিত্যিক শিল্পীবৃন্দ তাদের সীমিত সামর্থ নিয়ে মানবিক সৌন্দর্যের জন্য বার বার প্রতিবাদীদের ভূমিকা নিয়েছে বলিষ্ঠভাবে। বলা যায়, কবি সাহিত্যিকদের সুকুমার স্বপ্ন বুননের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিবেশ থেকে তৈরি হয়েছে নতুন জনমত, নতুন রেনেসাঁ ও বিপ্লব। মানুষের সুকুমার মনোগঠনের পক্ষে তা সভ্যতাকে সংহত করেছে বিভিন্নভাবে। আজকের সভ্যতা আর কারও দান নয়, এসব অবহেলিত মানব সন্তানদেরই দান। এই কথা সভ্যতার ধুরন্ধুর চালাক মানুষ বিশ্বাস করুক আর না করুক সেটাই সত্য। বিজ্ঞান মানুষের মস্তিষ্কে অউশ্ৎবিশের মত হত্যাকা- ঘটাতে প্ররোচিত করেছে, মানুষকে মেরে ফেলার জন্য গ্যাসচেম্বার বানাতে প্ররোচিত করেছে, সভ্যতার শুরু থেকে শিল্প মানুষকে বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছে। অলাঁ রেনে থেকে শুরু করে সলঝোনোৎসিন, মহাকবি আলাওল, জাঁ পল সার্ত, এসএম সুলতান, শিল্পী সুব্রানিয়াম, পরিমল ভট্টাচার্য, আহমদ ছফা, মিলান কুন্দেরা, ফ্রিদা কাহালো, পিকাসো, দালি, পল এপোলিয়ান, আন্দ্রে ব্রেত, একবাল আহমদ, গারসিয়া লোরকা, নাজিম হিকমত, এডোনিস, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ. গ্রন্টার গ্রাস, সুকান্ত ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম, আহমদ শরীফ, এডোয়ার্ড সাঈদ, নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গো, এমে সেজায়ার, ফ্রানস ফানো, গ্রামসি, নিকানোর পাররার, পাবলো নেরুদা, নিকুলাই গোগল, লেভ তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, মুজামিল জামিল, গ্ল্যালডিস স্টেইন, অক্তাভিও পাজ, সোমানাথ হোর, পল এলুয়ার, ফ্রান্সিস বেকন, আন্দ্রেই তারাকাভস্কি, বান নাথ, রঘু রাই, রঞ্জিত হাসকোট, লুই বুনুয়েল, উর্বশী বুটালিয়া, হর্ষ মান্দার, স্বর্ণ চিত্রকর, মোহসেন মকমলবাফসহ অসংখ্য মহৎ কবি, লেখক, শিল্পীগণের নাম করা যায়। তারা প্রমাণ করেছে নিপীড়িত মানুষের জন্য তাদের নিবেদন। সভ্যতার ক্রম বিকাশে এই সরল কবি ও লেখক তাদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে প্রমাণ করেছে, পুঁজি যেদিকে মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে আসলে মানুষের পথ তা না, মানুষের পথ হচ্ছে সুকুমার মানবতাকে সম্মান করা, মানবিকতার যত উপযোগ আছে তাকে সম্মান করা, প্রত্যেক মানুষকে ভালোবাসা। সে যে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের হোক না কেন। মানব সভ্যতার সেই সম্মানবোধের জায়গা থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রথম আয়োজন করছি- রোহিঙ্গাদের জন্য কবিতা, মানবতার জন্য কবিতা। সবার অংশগ্রণের মধ্য দিয়ে এই অনুষ্ঠান আর্ন্তজাতিকতায় রূপ নিবে এবং রোহিঙ্গা জাতির মুক্তির পক্ষে জনমত তৈরি হবে বলে মনে করি।

৮ম শতাব্দী থেকে রোহিঙ্গারা আরাকানের নাগরিক হিসেবে বসবাস ও যাত্রা শুরু করে। হাজার বছরের নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে তারা বঙ্গোপসাগরের তীরে একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলে। সেই থেকে রোহিঙ্গা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধদের সম্মিলিত যাত্রায় আরাকানের সংস্কৃতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতায় রোহিঙ্গা, থাম্বুইক্কা, জেরবাদী, কামানচি জনগোষ্ঠীর বিপুল অবদানের কথা। তারা এই ভূমিতে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে একটি মানবিক সভ্যতার জনক হয়ে উঠেছিলো। মুসলমান, হিন্দু, বড়–য়া, রাখাইন (মগ) সম্প্রদায় মিলে একটি সহনশীল নান্দনিক সংস্কৃতির ভিত্তিতে আরাকানের স¤্রাটগণ তাদের শৌর্যবীর্য দিয়ে মন্ডু-আকিয়াব-পাথুরে কিল্লাহসহ বাংলাদেশের ফেনী পর্যন্ত বিস্তৃত আরাকান সা¤্রাজ্য গড়ে তুলে। যাকে ইতিহাসে বঙ্গোপসাগরীয় আরাকান সভ্যতা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ১৭৮৪ সালে দখলদার বার্মা (মিয়ানমার) অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে আরাকান দখল করে নিলে সেখানকার মানুষের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়। রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন- এ দু’সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা চালিয়ে আরাকানের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার বর্বর প্রক্রিয়া শুরু করে। হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকৃত ব্রিটিশ বঙ্গের রম্যভূমি রামু, ঈদগাহ, চকরিয়া, নাইক্ষংছড়ি, লামা, বান্দরবান, রাঙামাটি, বরিশাল ও বরগুনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং বসতি শুরু করে। তারপর ধাপে ধাপে কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে থাকে নিপীড়নের স্টিমরোলার। ধর্ম ও আচারে একইরকম হওয়ায় রাখাইনদের (মগ) মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা আত্মীকরণ করে নেয় এবং আরাকানের নাম মুছে দিয়ে ‘রাখাইন স্টেট’ ঘোষণা করে।। কিন্তু রোহিঙ্গারদের অধিকাংশ মুসলমান হওয়ায় এবং ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন হওয়ায় তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেয়নি মিয়ানমার। আরাকান কখনও মিয়ানমারভুক্ত দেশ ছিল না। আরাকান ছিল নিজের সত্তায় সার্বভৌম একটি সা¤্রাজ্য। বার্মারও কিয়ৎ অংশ আরাকান সা¤্রাজ্যভুক্ত ছিল। মিয়ানমার মূলত এখানে দখলদার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর ভূখ-ের ইতিহাস পাল্টে গেলে ১৭৮৪ থেকে ধাপে ধাপে বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গা আর নিজ দেশে আর ফিরে যেতে পারেনি। যারা সেট্লোর্স হিসেবে বাংলাদেশে বসবাস করেছে তারা বাঙালি হয়ে গেছে; আবার যারা ১৯৪৮ সালের পরে আরাকানে থেকে গেছে তারা রোহিঙ্গা হিসেবে মিয়ানমারে তাদের জাতিসত্তাকে নবায়ন করে নিয়েছে। ১৯৪৮ সালের রাজনৈতিক মেরুকরণ পৃথিবীর প্রত্যেক দেশই মেনে নিয়েছে শুধু মেনে নেয়নি বার্মার বর্বর শাসকগোষ্ঠী যার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না। তাদেরকে অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। তারা এমন বর্বর আক্রমণ করেছে হয় রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাবে নয়ত মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে। প্রায় চার শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এই মজলুম নির্যাতিত জনগোষ্ঠি যে বিপদ ও বিপর্যয় রোধে পৃথিবীর কোন দেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে নি।

১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার্মা সরকারকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে চরমপত্র পাঠালে সেই সময় বার্মা সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উৎসাহ দেখায়। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া একপ্রকার মৃত্যু হয়। বিশ্বের আর কোন নেতা, আর কোন দেশ রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এমন সাহসী ও মানবিক ভূমিকা নেয়নি। যার কারণে মিয়ানমার সরকার বেপরোয়াভাবে তাদের নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে।

৬ নভেম্বর প্রথম আলোর সংবাদে বিশ্বের মানুষের সামনে আরেকটি বর্বর ইতিহাস লেখা হয়ে গেল, মানব ইতিহাসে যা কোনভাবে কাম্য নয়; মিয়ানমার সরকার বেসামরিক রাখাইন জনগণকে অস্ত্র দেবে রোহিঙ্গা নিরীহ জনগণকে মেরে ফেলার জন্য। প্রকাশ্যে বিশ্বের কোন দেশের সরকার এমন সাহস দেখায়নি অথচ মিয়ানমার তা দেখাল, বিশ্বমানবতাকে অপমান করল, তারপরও বিশ্বের সচেতন মানুষ নিরব, কেন নিরব তা কেউ জানে না।

এই সংবাদের ঘোষণা এই শতাব্দীর জঘন্য দুঃসংবাদ এবং পরমাণু বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর। মিয়ানমার সরকারের এই ঔদ্ধত্য থামাতে হলে- বিশ্বের সব দেশ ও সরকারকে একজোট হয়ে এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে- বর্বরতা, নৃশংসতা, নিপীড়ন কোন জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না; বরং তা দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা ডেকে আনে।

বিশ্বের মানবতাকে রক্ষা করতে হলে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশ জাতি নির্বিশেষে সবাইকে এককাতারে এগিয়ে আসতে হবে। তাই নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি জানিয়েÑ২ ডিসেম্বর ২০১৬ বিকেল ৩টায় শাহবাগ চত্বরে (Poetry for Rohingyas, Poetry for Humanity) ‘রোহিঙ্গাদের জন্য কবিতা, মানবতার জন্য কবিতা’ নামে একটি ব্যতিক্রম ধারার সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশের কবিদের পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠানটি সারা পৃথিবীতে ব্যাপক আলোড়ন তুলে এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ৯ ডিসেম্বর ২০১৬ খৃস্টাব্দের হামলার রক্ত শুকাতে না শুকাতে ২৫ আগস্ট ২০১৭ আবারও শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন। একটি জাতিকে নির্মূল করার সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়ে হামলা করতে থাকে মিয়ানমার সরকার। যে হামলা পৃথিবীর ইতিহাসে আরও একটি কলঙ্ক জনক অধ্যায় হিসেবে মানব সভ্যতাকে প্রশ্নবীদ্ধ করলো। কবিতার রাজপথ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে। সংকলন, প্রতিবাদী কবিতা পাঠ, সেমিনার, মানব বন্ধন এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সচেষ্ট। তারই ধারাবাহিকতায়Ñ ০৭ অক্টোবর- শনিবার, ২০১৭ কবিতার রাজপথ হাতে নিয়েছে (Poetry for Rohingyas, Poetry for Humanity) ‘রোহিঙ্গাদের জন্য কবিতা, মানবতার জন্য কবিতা’ বন্ধুরা, দলমত নির্বিশেষে উপস্থিত থেকে বিশ্বমানবতার এই অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সম্পাদক

মনির ইউসুফ

২/৪ নবাব হাবিব উল্লাহ রোড

শাহবাগ, ঢাকা-১২০৫