ডেস্ক নিউজ:

রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই প্রথম ইতিবাচক মানসিকতা দেখিয়েছে মিয়ানমার। সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় এই বৈঠকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে তারা। তবে গত বছরের অক্টোবর থেকে যারা পালিয়ে এসেছে, সেসব রোহিঙ্গাদেরই ভেরিফিকেশন সাপেক্ষে ফেরত নেওয়ার কথা বলায় তারা পরোক্ষভাবে ছয় লাখ রোহিঙ্গার বিষয়ে কথা বলছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রস্তাব হচ্ছে- ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে, তাদের সবাইকে ফেরত নিতে হবে। সে সংখ্যা ৯ লাখের কম নয়।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার বৈঠক
বাংলাদেশের আহ্বান এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বৈঠকে বসতে সম্মত হয় মিয়ানমার। সোমবার (২ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সেলর অফিসের মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে এ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে আগের তুলনায় খানিকটা নমনীয় মনে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে একাধারে অস্বীকার করার পর এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন সাপেক্ষে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। তবে তারা বৈঠকে শর্তারোপ করে কেবল ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে যারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, ভেরিফিকেশন সাপেক্ষে কেবল তাদের তারা ফেরত নেবে। এর আগে যারা এসেছে তারা বিবেচ্য হবে না।
এর বিপরীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পক্ষ তাদের জানায়,এদেশে বর্তমানে ৯ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে এবং তাদের সবাইকে ফেরত নিতে হবে।
উল্লেখ্য,গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার এবং ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আর এর আগে থেকেই প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। অর্থাৎ মোট ৯ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একমত হলেও এই রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে এখনও মতবিরোধ আছে।
অর্থাৎ আগের তিন লাখ বাদ দিলে মিয়ানমারের দাবি এদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছয় লাখ,আর আগে আসা রোহিঙ্গাদের উল্লেখ করে বাংলাদেশের দাবি এদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে ৯ লাখ।

এ বিষযে জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি এক বৈঠকে সমাধান হবে না। আজকের বৈঠক নিয়ে আমরা উৎসাহিত নই এবং একইসঙ্গে নিরুৎসাহিত নই। সামনের দিনগুলোতে এবিষয়ে আরও অনেক বৈঠক হবে।সেখানেই এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে রাখাইনে যা নারকীয় ঘটনা ঘটেছে সেটির ব্যাপ্তি এত বড় যে এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহজে লুকানো সম্ভব নয় এবং মিয়ানমার এটি জানে বলে তারা আমাদের সঙ্গে বৈঠক করছে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক চাপ বজায় থাকলে বাংলাদেশে অবস্থিত সব রোহিঙ্গাকে ফেরত দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেরত পাঠানো সম্ভব। আবার চাপ কমে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হবে বলে তিনি জানান।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলে সারা বিশ্ব এর নিন্দা জানায় এবং সহিংতা বন্ধের আহবান জানায়। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত আলোচনায় ১৩জন সদস্য রাখাইন ঘটনার চরম নিন্দা জানায় কিন্তু রাশিয়া ও চীন ভিন্নমত পোষণ করে।

বৈঠকে আলোচ্য বিষয়
আজকের বৈঠকে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়টি ছাড়াও তারা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন,ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া এবং এর সঙ্গে কারা যুক্ত থাকতে পারেন সেটি নিয়েও আলোচনা হয়।
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালের আগস্টে দুইদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি ৩০ সদস্য বিশিষ্ট জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই কমিটি কোনও কাজে আসবে না।
ফলে নতুন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয় এবং ধারণা করা হচ্ছে এর সদস্যরা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ে হবে।
ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয় রোহিঙ্গাদের কাছে কোনও কাগজপত্র নেই, ফলে এই প্রক্রিয়া হতে হবে নমনীয়। এর জবাবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়।
বৈঠকে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় কারা যুক্ত থাকবে এই বিষয় নিয়ে মিয়ানমারের প্রস্তাব হচ্ছে তারা ভেরিফিকেশন করবে।কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ ভেরিফিকেশন এবং সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে বলে জানানো হয়।
তবে এতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সংযুক্তির বিষয়ে মিয়ানমার নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বলে আন্তর্জাতিক রেডক্রস এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

ফেরত পাঠানোর চুক্তি

মন্ত্রী পর্যায়ের এ বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন,১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য যে সমঝোতা হয়েছিল তার আদলে এবং প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফাসহ অন্যান্য যেসব প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা হয়েছে,এ চুক্তিতে সেগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে।