হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :

ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র হাতে পেয়ে রোহিঙ্গারা কিছুটা খুশি হলেও জাতীয়তায় ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান’ উল্লেখ না থাকায় বিশেষতঃ ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ না থাকায় বেজায় নাখোশ প্রকাশ করেছেন ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র পাওয়া অনেক রোহিঙ্গা। তম্মধ্যে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীদের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের মাধ্যমে এসব পরিচয় পত্র দেয়া হচ্ছে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়ার ৩টি কেন্দ্রে ৩২ হাজার ২৫৩ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। তবে পরিচয় পত্রে জাতি হিসেবে ‘রোহিঙ্গা’ না থাকায় অনেকের চোখে মুখে বিষন্নতাভাব দেখা গেছে। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৫ থেকে উর্ধ্বে বয়সীদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, কত তারিখে এসেছে, মিয়ানমারে তাদের বাড়ির সংক্ষিপ্ত ঠিকানা লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে লেমেনেটিং করে পরিচয়পত্র প্রদান করা হচ্ছে।

পরিচয়পত্র পাওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা তরুন-তরুনী বলেন ‘মিয়ানমারে না হোক, বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র পেয়ে আমরা খুশি হলেও রোহিঙ্গা শব্দ উল্লেখ না থাকায় ভাল লাগছেনা। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা মেনে নিলে আমরা নিজ মাতৃভুমি মিয়ানমারে শিগগিরই ফিরতে চাই’।

কিশোরী বেবী আসমা, মায়মুনা ও সাদিয়া বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়ে পরিচয় পত্র হাতে পেয়ে গলায় ঝুলিয়ে বুথ থেকে বের হয়ে আসার সময় কথা হয় তাদের সাথে। তারা মিয়ানমারের জাতীয়তা হিসেবে নিবন্ধন হতে পেরে উৎফুল্ল। তাদের মধ্যে বেবী আসমা কার্ডটি তুলে ধরে জানতে চান পরিচয় পত্রে জাতীয়তা কি লেখা আছে। কার্ডটি দেখে তাকে জাতীয়তা ‘মিয়ানমার’ বললে ফের প্রশ্ন করে বেবী আসমা। ‘রোহিঙ্গা’ লেখা নেই ? ‘লেখা নাই’ বলা হলে তখন তার চোখে মুখে বিষন্নতা নেমে আসে।

এদিকে স্থানীয় সচেতন মহল জানান রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্রে অস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা এবং ভুল ঠিকানার কারণে অতীতের মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলেও ভুল ঠিকানার গ্যাড়াকলে পড়ে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সীমান্তের মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যটি (পরিবর্তিত নাম রাখাইন স্টেট) এক সময়ে আকিয়াব (বর্তমান নাম সিটওয়ে) ১টি মাত্র জেলার অর্ন্তগত ছিল। পরবর্তীতে তা ৪টি জেলায় বিভক্ত করা হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে আকিয়াব বা সিটউয়ে, মংডু, চপ্রু, টাংগুয়ে। ৪টি জেলার অধীনে পুরো আরাকানকে ১৭টি থানা বা টাউনশীপ করা হয়। টাউনশীপগুলো হলো আকিয়াব, মংডু, বুচিদং, রাচিদং, পুংনাজুয়ে, কিয়ট্র, পাত্তরিকিল্লা, মাম্ব্রা, পকটু, ¤্রগেুং, অং, চপ্রু, রামব্রি, মেঅং, টংগু, টেংগুয়ে, গোয়া। তম্মধ্যে আকিয়াব বা সিটওয়ে জেলার ৭টি টাউনশীপ বা থানা হচ্ছে আকিয়াব, রাচিডং, পুংনাজুয়ে, কিয়ট্র, পাত্তরিকিল্লা, মাম্ব্রা, পকট। মংডু জেলার ২টি থানা হচ্ছে মংডু ও বুচিডং। শুরুর দিকে বুচডংকে জেলা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্ত ৩ বছর পর নাসাকা বাহিনীর আমলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বুচিডংকে মংডু জেলার আওতাভুক্ত করা হয়। চপ্রু জেলার ৬টি থানা হচ্ছে চপ্রু, ¤্রগেুং, আং, রামব্রি, মেঅং, টংগু। টাংগুয়ে জেলার ২টি থানা হলো টাংগুয়ে ও গোয়া।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উল্লেখিত ৪টি জেলার অর্ন্তগত কোন না কোন ১৭টি থানা বা টাউনশীপের বাসিন্দা। কিন্ত আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী বিশেষতঃ মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার হার এবং অবস্থা এতই কাহিল যে নিজে কোন্ জেলা ও কোন্ থানার বাসিন্দা তা বলতে পারেনা। ‘সকলের মুখে একই কথা- থানা মংডু, জেলা আকিয়াব’। অথচ ১৯৭৪ সাল থেকেই নতুন জেলা ও থানার প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থা চলে আসছে। কিন্ত বাসিন্দাগণ রোহিঙ্গারা এমনকি লেখাপড়া জানা লোকও তা জানেনা। ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলেই এক কথায় সাফ জবাব দেয় গ্রামের নামের পর ‘থানা মনডু, জিলা আইক্কাপ’। সেদেশের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন করা হলে অতীতের মত প্রত্যাবাসন এবং দ্বি-পাক্ষিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্যার আশংকা রয়েছে। যা ইতিপুর্বেও একাধিকবার ঘটেছে।

উল্লেখ্য, প্রাপ্ত তথ্য মতে পুরো আরাকানে ১ হাজার ১৬৪টি গ্রামের মধ্যে ১৭৯টি গ্রাম এখন মানবশূণ্য হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। পুরো আরাকানের ৪টি জেলার ১৭টি টাউনশীপ বা থানায় ১১৬৪টি ইউনিয়ন বা গোয়াইং রয়েছে। এর মধ্যে মংডু, বুচিদং, রাচিডং ও আকিয়াব এ ৪টি থানায় মুসলমান রোহিঙ্গা সংখ্যাগরিষ্ট। তম্মধ্যে মংডু থানায় ইউনিয়নের (তাঁদের ভাষায় গোয়াইং) সংখ্যা হচ্ছে ১০৫টি এবং বুচিদং থানায় ইউনিয়নের (তাঁদের ভাষায় গোয়াইং) সংখ্যা হচ্ছে ৮৫টি। এ ২ থানায় মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগই রোহিঙ্গা মুসলমান। অবশিষ্ট ১৫ ভাগ রাখাইন, চাকমা, মুরং, চাক, কুই, সিং। আগে নাকি শত ভাগই মুসলমান ছিল। ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের উচ্ছেদ করে তদস্থলে রাখাইন ও কিছু ভিন্ন নাডালা (ভাসমান) জাতিদের বসতি স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ১৭টি থানায় মুসলমানদের সংখ্যা তুলনামুলক কম।