জসিম মাহমুদ,টেকনাফ :

সন্ধ্যা নেমে এসেছে, তখনও টেকনাফের উনছিপ্রাং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর ত্রাণ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দীর্ঘ সারি। হাজার হাজার মানুষের এ দীর্ঘ সারিতে বড় বোনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাত বছরের শিশু আজহার। বড় বোন হালিমা (১০) শক্ত করে ধরে রেখেছে আদরের ছোট ভাইকে। তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। কাছে গিয়ে কথা বলতে গেলেই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর তারা বলতে থাকেন, আমাদের এখান থেকে নিয়ে যান। খুব কষ্টে আছি। মিয়fনমfর থেকে বাবার হাত ধরে বাংলাদেশে এসে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। বাবা এখন কোথায় আছেন জানি না। মাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। বাবা-হারা আজহার ও হালিমা এখন আশ্রয় নিয়েছেন পুথিন পাহাড় আশ্রয় শিবিরে। ছোট ভাইটিকে নিয়ে হালিমা এখন দিশেহারা।

মিয়ানমার সেনা বাহিনী আগুনে পুড়ে মেরেছে অবুধ তিন সন্তানকে। আর বেঁেচ থাকা দুই সন্তানটাকে নিয়ে এপারে পালিয়ে এসে মায়ের হাতের মুঠোই থেকে হারিয়ে গেল দুই কন্যা সন্তান। শুক্রবার সকালে সন্তান দুইটি হারিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় খুঁজেও জায়গা মিলে না সায়েদা খাতুনের। সায়েদা খাতুনের পাচঁ সন্তান- মো. আলম (৮), মো. হাসিম (৫), মনির আলম (৪), দিলসাদ বেগম (৬) ও ছলিমা বেগম (৩)। বাড়ি মংডুর শিলখালী গ্রামের জামাল ছিদ্দিকের স্ত্রী। জামাল সেনাবাহিনীর হামলার পর পালিয়ে গিয়ে আর ফেরেননি।

সায়েদা খাতুন বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেখানে আক্রমণ করে গত সোমবার রাতে। শুক্রবার ভোরে নাফনদী পার হয়ে ২০ মিয়ানমার নাগরিক শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেন। পরে সাবরাং ইউনিয়নের হারিয়াখালী স্কুলের সামনে থেকে ট্রাকে করে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছেন। এরপর যে ট্রাকে করে এসেছেন সেখানে বুকের ধনদের না দেখে সাথে সাথে চিৎকার করতে থাকে। অনেক খোজাখুজি করে পেলেন না দুই সন্তানকে। সায়েদা খাতুন বলেন, ওপারে তিন সন্তানকে হত্যা করেছে সেনারা। এপারে এসে দুই সন্তানকে হারালাম। আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এখন আমি কি নিয়ে বেচেঁ থাকব? স্বামীও বেচেঁ আছে কিনা জানিনা। হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের কিভাবে ফিরে পাব জানি না।

নির্যাতনের শিকার হয়ে চার সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন মো. ইব্ররাহীম (৪৫)। তার বাড়ি মিয়ানমার গদুরছড়া গ্রামে। তিনি জানান, স্ত্রী জুহুরার লাশ ফেলে গত বুধবার ভোরে নাফনদী পার হয়ে চার সন্তনদের নিয়ে এপারে চলে আসেন। তার সঙ্গে ছিল, কলিমা (১৬), রোজিনা আক্তার (১৪), ছমিরা বেগম(১০) ও মো. ওলি হোসেন (৮)। তারা ওই সকাল ৮টায় শাহপরীর দ্বীপ থেকে নৌকা করে হারিয়াখালী ভাঙ্গার মাথা পৌঁছেন। নৌকার থেকে ওঠার পর জানতে পারেন তার এক মাত্র সন্তান ওলি হোসেন নেই। তিনি সন্তানদের এপারে রেখে ওপারে ছেলেকে অনেক খোঁজাখুজি করে না পেয়ে সন্ধায় হারিয়াখালী স্কুলে আশ্রয় নেন। পরেদিনও ছেলের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটেও পায়নি এক মাত্র ছেলে সন্তান ওলিকে।

পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সাথে বাংলাদেশে এসেছে প্রায় দুই লাখ শিশু। লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন প্রিয় শিশু সন্তানকে। সন্তানহারা বাবা-মা আর তাদের ঠিকানা না জানা শিশুরা সময় পার করছে চোখের জলে।

টেকনাফ লেদা অনবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মো. রশিদ বলেন, রোহিঙ্গাদের এতো চাপ কে কোথায় যাচ্ছে খোজঁ রাখা খুবই মুশকিল। আমি বাংলাদেশে এসেছি ১২ বছর পার হয়ে গেলে। গতকাল শুক্রবার সকালে আমার দুই সন্তানও হারিয়ে যায় আবার অনেক খোজাখুজির পর প্রধান রাস্তার পাশে পেয়েছি।

তিনি বলেন, নতুন অনুপ্রবেশকারি অনেক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষরা তাদের সন্তানদের হারিয়ে ফেলেছে। এ পর্যন্ত আমারা খোজাখুজি করে হারিয়ে যাওয়া দশ পরিবার তাদের সন্তান ফিরে পেয়েছে।

এ দিকে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের আবারও নিজ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করতে টেকনাফে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বুথ চালু করেছে কামাল নামের একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। একটি মঞ্চ বানিয়ে তিনি নিখোঁজদের বিষয়ে মাইকিং করছেন। ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’-এর সাহায্যে এ পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া কয়েকশ শিশুকে নিজ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করেছেন কামাল।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, তার ইউনিয়ন শুক্রবার ভোর ও সকালে কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে ৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। নাফনদী উত্তাল থাকলেও মিয়ানমারে সেনাদের অভিযানের মুখে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে রোহিঙ্গারা। তাদের মুখে একই গল্প, মিয়ানমার সামরিক জান্তার ভয়াবহতার কথা।