মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দোসর মগ সম্প্রদায় চেয়েছিল তাদের সোর্স হিসেবে কাজ করুক রোহিঙ্গা হিন্দুরা মুসলামনদের ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য দিক তাদের। মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে উগ্রপন্থিরা চাইত তাদের পক্ষে কাজ করুক হিন্দু রোহিঙ্গারা। দুপক্ষের টানাটানির এক পর্যায়ে শক্তি প্রয়োগে রূপ নেয়। শুরু হয় নির্যাতন। এ কারণে নিজ দেশ ছাড়ে তারা। এমনই ভাষ্য পালিয়ে আসা হিন্দু রোহিঙ্গাদের। নিজ দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে এমনই কথা বলেন তারা। উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় মিলেছে হিন্দু রোহিঙ্গাদের। সেখানে দেখা হয় জগদীশ চন্দ্রের সঙ্গে। মংডুর চিকনছড়ি গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন। পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে থাকছেন হিন্দু ক্যাম্পে।

কী কারণে নিজ দেশ ছাড়লেন- এমন প্রশ্নে জগদীশ জানালেন, মংডুর চিকনছড়ি গ্রামটির বেশিরভাগ বাসিন্দা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তবে আশপাশের সব কটি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন মুসলিম। তবে সবাই রোহিঙ্গা জাতি। মগরা সেখানে সংখ্যায় কম। কিন্তু সেনাবাাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে তাদের সব সময় দাপট ছিল। তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় সব খবর সেনাবাহিনীকে নিয়মিত দেয় মগরা। বিশেষ করে মুসলমান রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সব সময় সেনাবাহিনীকে তথ্য দিত। হিন্দুদের তারা শত্রু মনে করে না, কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ না করলে তাদের দালাল বলে নির্যাতন করে মগরা।

জগদীশ বলে চলেন, মুসলমান রোহিঙ্গাদের সবাই শান্তিপ্রিয়। অল্প কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম উগ্রপন্থি। তারা হিন্দু রোহিঙ্গাদের জোর করত যেন চুপ থাকে সেনাবাহিনী বা মগদের কাছে কোনো ধরনের তথ্য না দেয়। হিন্দু রোহিঙ্গাদের শত্রুও আখ্যা দেয় তারা। নির্যাতন করে। কিন্তু হিন্দু রোহিঙ্গারা কোনো পক্ষেই কাজ করতে চাইত না। এ কারণে সবার শত্রু হয়ে যায়। পরে বাধ্য হয়ে দেশ (রাখাইন) ছাড়তে হয়।

জগদীশ যখন আমাদের কাছে মংডুর হিন্দু রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন, তখন অনেক হিন্দু শরাণার্থী সেখানে জড়ো হন। তারা সবাই ঘটনার একই রকম বর্ণনা দেন। কুতুপালংয়ের হিন্দু শরণার্থী ক্যাম্পে ৫২৩ রোহিঙ্গা হিন্দু আশ্রয় নিয়েছে। মোট পরিবার ১৬০। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন তারা।
উখিয়া উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য অজিত শর্মা হিন্দু শরণার্থীদের দেখাশোনা করছেন। তিনি বলেন, হিন্দু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়ার কারণ ভিন্ন। তারা মূলত মগ ও মুসলমান রোহিঙ্গা দুপক্ষের বিরুদ্ধেই নির্যাতনের অভিযোগ জানাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর নির্যাতন তো আছেই।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু শরণার্থীদের ওপর হামলা এবং দুজনকে অপহরণের বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছে স্থানীয় পুলিশ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠিকমতো ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টিকে ঘোলাটে করতে হিন্দু রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে মুসলমান রোহিঙ্গাদের কাজে লাগাতে কোনো তৃতীয় পক্ষ তৎপর কিনা, তা তদন্ত করছে পুলিশ।

১০ সেপ্টেম্বর ১০ রোহিঙ্গা হিন্দু নিখোঁজ হন। বুধবার পর্যন্ত চার দফায় আটজন ফিরে এলেও অপর দুজন ফিরে আসেননি। নিখোঁজের কয়েক দিন পর বালুখালী নদী থেকে উদ্ধার হওয়া লাশটি রবীন্দ্র পালের বলে দাবি করেছে পরিবার। যদিও পুলিশ বলছে, বিষয়টি নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। নিখোঁজ অপর ব্যক্তি হলেন নিরঞ্জন শীল (৬০)। এ ঘটনায় উখিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন হিন্দু রোহিঙ্গারা।

আহত অবস্থায় ফিরে আসাদের বরাত দিয়ে তাদের দেখভালের দায়িত্বরত বাবুল শর্মা বলেন, মিয়ানমার থেকে নির্যাতনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া হিন্দুরা রাখাইনে প্রায় ৩৫টি গরু-ছাগল ফেলে আসে। সেসব নিয়ে এসে বিক্রি করেন রাখাইনে তাদের প্রতিবেশী অলি উল্যাহ, ইমাম হোসেন, নুরুল হক। তারা গরু-ছাগল বিক্রির সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেওয়ার কথা বলে সীমান্তের ওপারে তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। একটি নদী পার হওয়ার পর তাদের চোখ বেঁধে নির্যাতন চালানো হয় বলে জানিয়েছেন সেখান থেকে ফিরে আসা হিন্দু রোহিঙ্গারা। কৌশলে আটজন পালিয়ে আসতে পারলেও অন্য দুজন পারেননি।

অজিত শর্মা বলেন, ৩০-৪০ রোহিঙ্গা তাদের নির্যাতন করেছে। এর মধ্যে ১০ জনকে চিনতে পেরেছেন নির্যাতিতরা। উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বৃহস্পতিবার বলেন, একসঙ্গে লাখ লাখ লোক একটি থানা এলাকায় ঢুকে পড়ায় নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ওসি। ওসি বলেন, অন্য কোনো পক্ষ এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে কিনা, সেটি মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। নিখোঁজদের খুঁজে বের করতে তৎপর পুলিশ। নিহত ব্যক্তি রবীন্দ্র শীল কিনা তা ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা যাবে। কারণ লাশটি পচে গিয়ে চেনার উপায় ছিল না।