ডেস্ক নিউজ:

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড় দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফের দিকে যাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধা। হারিয়াখালী এলাকা থেকে তোলা ছবি।ছবি: বাংলা ট্রিবিউন
রোহিঙ্গাদের প্রতি ভারতের সহানুভূতিশীল লবিস্ট ও বিরোধী দলগুলোর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর রাখাইনের একটি গণকবরে নারী ও শিশুসহ হিন্দুদের ৪৫টি মরদেহের খোঁজ পায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। মূলত এরপরই ভারতে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া হিন্দুদের একটি দল বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রায় একশ জনকে সশস্ত্র রোহিঙ্গা হামলাকারীরা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে।

ভারতের ইংরেজি ভাষার শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেওয়া বক্তব্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, নিহত ব্যক্তিরা সশস্ত্র রোহিঙ্গা জঙ্গিদের হামলার শিকার হয়েছে। যারা আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমারের পুলিশ ও থানায় হামলা চালিয়েছে তারা হিন্দুদেরও রেহাই দেয়নি। ওই হামলার ফলশ্রুতিতেই মিয়ানমার ব্যাপক আকারে সামরিক অভিযান শুরু করে। এতে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়, সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু মুসলমান।

এদিকে, রাখাইনে হিন্দু গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবরে ভারতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রচারণা আরও জোরদার হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল নেতা আসাদউদ্দিন ওআইসি’র মতো নেতা এবং কিছু মানবিকার সংগঠন এ ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তারা গত কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত ৪০ হাজার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া অথবা রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পক্ষপাতি।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই ঘোষণা দিয়েছে, মিয়ানমারে মুসলমানদের লক্ষ্য করে জাতিগত সহিংসতার কারণে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা সব বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে তাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে জাতিগত সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর কারণে চার লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে; যাদের বেশিরভাগই রিক্তহস্ত।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মিয়ানমার যেন তার নিজ দেশে নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করে; যেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যেতে পারে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে জোর প্রচেষ্টা চালান। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর এবং সর্বোচ্চ নেতা অং সাং সুচি আঞ্চলিক অনুভূতির কথা বিবেচনা করতে বাধ্য হন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মিয়ানমার তার সাবেক নাগরিকদের নিয়ে যাবে।

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং অন্যান্য নেতারাও এটা স্পষ্ট করেছেন যে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের হত্যা বা হয়রানি করা হবে না। একইসঙ্গে তাদের কোনোভাবেই বসতি স্থাপনের অনুমতিও দেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় সরকার মনে করে, তাদের উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার জন্য স্পষ্টতই বিপদজনক।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছে সম্প্রতি এ ইস্যুতে একটি হলফনামাও দাখিল করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে অন্যান্য তথ্যউপাত্ত অন্তর্ঘাত, চরমপন্থী হামলা ও বিস্ফোরণের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো থেকে বিরত থাকার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং মানবাধিকারকর্মীরা। একইসঙ্গে তারা পুরো সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা না করার আহ্বান জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে এটি শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর আগেও যখনই ভারত সন্ত্রাসী তৎপরতার প্রমাণ নিয়ে কাউকে বহিষ্কার করেছে; তখনই রোহিঙ্গাদের পক্ষে যৌথভাবে শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরেছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।

এখন হিন্দুদের গণকবর আবিষ্কারের ফলে রোহিঙ্গাপন্থী লবিগুলোর জন্য বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, হিন্দুদের ওপর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেস, আসাদউদ্দিন ওআইসি বা কোনও মানবিকার সংগঠন নিন্দা জানানোর বাইরে কোনও মন্তব্য করেনি। জামায়াতে ইসলামী হিন্দের নেতা ছিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কাছে তার সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের কথা বলেছেন।
অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিয়ানমার সম্পর্কে পাওয়া খবরের যুক্তি পাল্টা যুক্তি রয়েছে। দাফতরিকভাবে না বললেও কলকাতার একজন মানবাধিকারকর্মী উল্লেখ করেছেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হিন্দুদের গণকবরের তথ্য প্রকাশ এবং এরপর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো ভারতে ডানপন্থীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একেবারে যথাযথ সময়। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, মিয়ানমার সব ব্যাপারেই তাদের অরক্ষিত, নেতৃত্বশূন্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করবে।

কলকাতার বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন বৌদ্ধরা বা মিয়ানমার পুলিশ হঠাৎ করে হিন্দুদের আক্রমণ করবে? রাখাইনের রাজনৈতিক সমীকরণকে বিবেচনায় আনবে না? নারীদের ধর্ষণ এবং হিন্দু শিশুদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে কী বলা যায়?

সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আগস্টে মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ করে ডজনখানেক মানুষকে হত্যা করে। তাই অনেক অস্ত্রই সহজলভ্য। তাই এসব ঘটনায় রোহিঙ্গাদের দায়মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়; বিশেষ করে রাখাইনের মতো সহিংসতাপ্রবণ এলাকায়।

স্পষ্টতই এ সমস্যা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও বেশি উত্তাপের জন্ম দেবে।