কবির হোসেন সিদ্দিকী:
আমার বাবা একজন পানিওয়ালা। পানি ফেরি করে তিনি আমাদের মানুষ করেছেন। অনেকে এখনো আমাকে পানিওয়ালার ছেলে বলে ঠাট্টা করে। আমি মজা পাই গর্ববোধ করি। আমি পানিওয়ালার (পানি বিক্রেতা) ছেলে।
বাজারে সারাদিন পানি ফেরি করে বাবা যা আয় করতেন তা দিয়ে আমাদের কোন রকম সংসার চলতো। মাসে নিহায়েত ৭-৮ দিন আমরা না খেয়ে থাকতাম কিন্তু এনিয়ে আমাদের কোন অনুযোগ নেই। পরিশ্রমি মানুষটি সারা জীবনই জ্বলেছেন। তিনি সুখের সময়ে চলে গেলেন। কোন কষ্ট ছাড়াই আমার সাথে কথা বলার ৫ মিনিটের মধ্যেই। আমি নামাজে ছিলাম তখন।
ঢাকা যাবো। তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় গেলাম। তখন সময় ৮টার একটু বেশি। বাবা তার তিনটা ব্যাগ রেডি করে আমার সামনে আসলেন। দরজার সামনে সেন্ডেল রাখলেন বাসার নিচে যাওয়ার জন্য। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কই যাবেন?
বললেন নিচে যাবো কন্টিন ট্যাবলেট আনতে। তাকে তিনটা ১০ টাকার নোট আর একটা ২ টাকার নোট দিলাম। বললাম গুনেন। তিনি গুনে বললেন ৩২ টাকা। হাসলাম। পরে বাবা আমার অফিসের (অফিস সহকারী) মিসকাতকে ১০ টাকা দিয়ে বললেন ২টা কন্টিন আনতে। আমি বাবাকে বললাম আপনিতো এর চেয়ে ভালো ওষুধ খাচ্ছেন। কন্টিন লাগবে না বাবা। এই বলে আমি আর কামারুল ভাই এশার নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজ থেকে শুনছিলাম বাবা বেসিনে বমি করছেন। ফরজ নামাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি আবার পাশে আসলাম। বমি করেই বাবা আমার কোলে ঢলে পড়লেন। ৫ মিনিটেই বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।
একজন পানিওয়াল মৃত্যুতে এই দেশের এই সমাজের কোন ক্ষতি হয়তো হয়নি। ইতিহাসেও তার নামও সোনার অক্ষরে লিখা থাকবে না। কিন্তু‘ আমার জীবনের ইতিহাসে তিনি অমর।
বাবার বয়স যখন ১ বছর তিনি বাবা আলী আহাম্মেদকে (আমার দাদা) হারান। দাদী অন্যত্র বিয়ে করেন। এক বছর বয়স থেকে তিনি জীবন যুদ্ধ শুরু করেন। সমাজের মানুষের চরম অবহেলা, লাঞ্চনা নিয়ে বেড়ে উঠেন তিনি। জীবনে কত শত দিন তিনি উপোস করেছেন সৃষ্টি কর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না।
কখনো অন্যের জমিতে চাষবাদ, কখনো চা ফেরি কখনো দৈনিক মজুরীর কাজ করেছেন তিনি। সমাজের মানুষের চরম অবহেলায়ও তিনি দমে যাননি। বাবা লেখাপড়াও করতে পারেননি। কোন দিন তাঁর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এক পর্যায়ে মা ছায়েরা খাতুন (আমার দাদী) পাগল হয়ে যান। অন্য ছেলেরা তাকে ফেলে চলে গেলেও বাবা তাকে নিয়ে সাতকানিয়া থেকে যুবক বয়সে বান্দরবানে পাড়ি জমান। শুরু হয় তার জীবনের চরম যুদ্ধ।
বান্দরবানে এসে এক সপ্তাহ না খেয়ে ছিলেন বাবা। তৎকালীন সময়ে বান্দরবানের নদী পাড়ে বলি খেলা হতো। সাত দিনের উপোস বাবা অংশ নেন বলি খেলায়। আছাড় খেয়ে পড়ে যান তিনি।
শান্তনা পুরষ্কার হিসেবে তাকে কিছু টাকা দেওয়া হয়। সে টাকায় বাবা আর তার পাগল মা আহার করেন। এভাবে জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বান্দরবানে এসে তিনি পানি ফেরির কাজে জড়িয়ে পড়েন। নদী-পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে মানুষের বাসায়-দোকানে অফিসে পানি ফেরি করতেন। পরে মায়ের সাথে তার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। একে একে জন্ম নেয় ৫ সন্তান।
সন্তানদের মানুষ করতে তিনি শুরু করেন নতুন যুদ্ধ। তিনি পুলিশ বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। চাকরীর প্রয়োজনে তাকে যেতে হয়েছে অনেক দুর-দুরান্তে। বেতনের সামান্য টাকায় চলতো না সংসার। শুরু হয় অভাব। আমরা ৫ ভাইবোন বড় হতে থাকি। খরচের বোঝা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ঘটে যায় জীবনের সব চেয়ে করুন ঘটনা।
বাবা লামায় চাকরীতে ছিলেন। আমরা দু’ভাই ৫ শ্রেণিতে পরিক্ষা দিবো। খাতা কলম বই কিনতে হিমসিমে পড়ে যান বাবা। চরম অভাব নেমে আসে সংসারে। দূর্বল মানুষ হওয়ায় বাজার ফান্ডের তৎকালীন এক কর্মচরীর সহযোগিতায় এবং মেম্বার পাড়ার আনোয়ার নামে এক জনের প্ররোচনায় আমাদের বসত বাড়ির একাংশ কেড়ে নেয় জহির নামে সরকারী এক কর্মচারী। বাবা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরিবার চালানো আর মামলার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বাবা-মা দু’জনই।
একদিন রাতের ঘটনা। রাতে বাসায় রান্না হয়নি। গভীর রাতে দাদী (পাগল ছিলেন) জেগে উঠে মাকে বললেন- মা আমাকে একটু ভাত দাও।
মা দাদীকে বললেন, মা আজতো ভাত রান্না হয়নি। কাল সকাল হোক, তোমাকে রান্না করে ভাত খাওয়াবো। আর সেদিন রাতেই না খেয়ে মারা যান দাদী। জীবন যন্ত্রণাতো এখানেই শেষ নয়। দাদীকে কাফন দেওয়ার মতো টাকা (চাকরীর কারণে তখন বাবা ছিলেন লামায়) মার হাতে ছিল না। পাড়ার মুরব্বি মাহাবুল আলম আর তার ছোট ভাই বাবুল মাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিল। সেই টাকায় দাদীর দাফনের কাপড় কেনা হয়। বেঁচে যাওয়া টাকায় সকালে আমরা ভাত কিনে খেয়েছিলাম। আমি দেখেছি বাবার লামার চিইরতলী পুলিশ ক্যাম্পে ১২০ সিড়ি বেয়ে পানি তুলতেন। আমি দেখেছি বাবা বেতনের সকল টাকা খরচ না করে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। আমি দেখেছি, বাবা তার থালার খাবার আমাদের খাইয়ে দিতে। জীবনের করুণ ইতিহাস যেন আমাদের ছাড়ার নয়, আমার দু’বোন খুব সুন্দরী ছিলেন। গরীবের মেয়ে বলে নানা জনের নানা কথা বলার ভয়ে বড় বোনকে বিয়ে দিতে হয়েছে একজন ড্রাইভারের সাথে। আর ছোট বোনকে একজন তরকারী ব্যপারীর সাথে।তৎকালীলন উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছ দু’বোনের বিয়েতে উজাড় করে খরচ করেছিলেন। দুঃখে যার জীবন গড়া, সুখ কি করে আসবে তার কাছে? আমি তখন সাংবাদিকতা শুরু করছিলাম মাত্র। মাকে পেয়ে বসে দুরারোগ্য ক্যান্সার। বড় বোনের জামাই-এর সহযোগিতায় তাকে ডুলাহাজারা খ্রিস্টান হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর বলা হয় মাকে চট্টগ্রাম নিয়ে থেরাপি দিতে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের আবার থেরাপি। অভাব যখন আমাদের নিত্য সঙ্গী মাকে তখন থেরাপী দেওয়া সম্ভব হলো না। এর পরে মায়ের শরীরে বাসা বাঁধে ডায়বেটিকস, হাপানীসহ নানারোগ। এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। মাকে হারানোর পর বাবা হয়ে যান আরো একা। মা মারা যাওয়ার পর আমি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকি। চলে যাই চট্টগ্রামে। বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার সহযোগিতায় আমি অনেক দুর এগিয়ে যাই। এগিয়ে আসে চট্টগ্রামের এস.আলম গ্রুপও।
এদিকে বাবার পরিশ্রমের শরীরে বাসা বাধে লান্স ক্যান্সার, হাঁপানী। বাবাকে আমি চট্টগ্রামে নিয়ে যাই। দেশের সকল নাম করা ডাক্তার দিয়ে তাকে চিকিৎসা করায়। কিন্তু বিধাতা তার লিখনতো পাল্টায়না। আমাকে এতিম করে ২১ সেপ্টেম্বর বাবা চলে যান পরপারে।
আমার বাবা কারো সাথে কখনো ঝগড়া করেছে, কারো সাথে কোন মনমালিন্য হয়েছে- আমি দেখিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর পাশ্ববর্তী হিন্দুরাও তার জন্য অঝোরে কেঁদেছেন। তার জানাজা ইতিহাসের পাতায় স্থান না পেলেও অনেক মানুষের উপস্থিতি ছিল।
বান্দরবানের হলি ডে ইনের ঘটনা। আমি তখন দৈনিক সাঙ্গুর সদ্য সম্পাদক হয়েছি। একটা অনুষ্ঠানে যোগদান করতে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে এসেছিলাম। ঢাকার এক মেহমানের সাথে পরিচয় হতে গিয়ে আমি তাকে বলছিলাম -আমি দৈনিক সাঙ্গুর সম্পাদক।
পাশে আমার এক বন্ধু চিৎকার করে বলছিলেন সম্পাদক না পানিওয়ালার ছেলে বল। সত্যিই আমি সেদিন অসংখ্য মানুষের সামনেই চিৎকার করে বলেছিলাম- আমি পানিওয়ালার ছিদ্দিকার ছেলে। আমার বাবা পানিওয়ালা ছিলেন। আমার বাবা পরিশ্রম করে আয়-রোজগার করেছেন। আমার বাবা রক্ত ঘাম জড়িয়ে টাকা আয় করেছেন। আমার বাবার টাকা ছিল সৎ রোজগারের টাকা। সারা জীবনে এক টাকাও অসৎভাবে রোজগার করেননি বাবা। তার রক্তে ঘামে কামানো টাকা খেয়েই আমি আজ কবির হোসেন সিদ্দিকী।
আজও সমাজের সামনে সবার সামনে আমি গর্ব করে বলি- আমি পানি ওয়ালার ছেলে। কে, কি বললো বা কি ভাবছে- তাতে আমার কিছুই আসে যায়না। আমার চির দুঃখি বাবার জন্য সকলের কাছে দোয়া ভিক্ষা করছি। বান্দরবানের কেন্দ্রিয় কবরস্থানে মায়ের পাশে শুয়ে আছেন বাবা।
এই লিখাটা যখন লিখছি, তখন গভীর রাত। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। আমার সাথে বাবার জন্য যেন প্রকৃতিও কাঁদছে।
যারা আমার বাবার মৃত্যুর পর সমবেদনা জানিয়েছেন, শোক প্রকাশ করেছেন- আমি তাদের প্রতি চরমভাবে কৃতজ্ঞ।
বিশেষ করে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতি।
তারা বাবার মৃত্যুর পর সার্বক্ষনিক আমার পাশে থেকেছেন। ওপারে ভালো থেকো বাবা।
লেখক : সম্পাদক দৈনিক বায়ান্ন, দৈনিক সাঙ্গু, দৈনিক প্রিয় চট্টগ্রাম, দৈনিক আওয়ার চট্টগ্রাম, সাপ্তাহিক নতুন ঈশান, অনলান দৈনিক দ্যা এডিটর, অনলাইল টেলিভিশন প্রিয় টিভি.কম।