হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
অবিশ্বাস্য হলেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রভাবে টেকনাফে এখন মুড়ির কেজি ৭০ টাকা। তাও পাওয়া যাচ্ছে কম। যারা সারা বছরই কম-বেশী মুড়ি খান এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা হঠাৎ মুড়ির মুল্য বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন।

মুড়ি বিক্রেতার সাফ জবাব ‘নিলে নেন, না নিলে অসুবিধা নেই, ক্রেতা অনেক আছে। কিন্ত ১ টাকাও কম হবেনা’। কারণ জানতে চাইলে মুড়ি বিক্রেতা বলেন ‘এখন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় কয়েক লক্ষ নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের চাল থাকলেও চুলা নেই। সর্ববয়সী মানুষের ক্ষিধে নিবারনে চিড়া ও মুড়ি অন্যতম খাদ্য। দুরদুরান্ত থেকে দানশীল ব্যক্তি, বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা কয়েক লক্ষ নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মাঝে ওজনে হালকা এবং তাদের জন্য উপকারী শুকনো খাবার হিসাবে হাজার হাজার মণ মুড়ি কিনে বিতরণ করছেন। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার তুলনায় উৎপাদন বাড়েনি। তাই দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা বছর কম-বেশী মুড়ির চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ জুড়ে মুড়ির সব চেয়ে বেশী চাহিদা থাকে ইফতারীর জন্য পবিত্র রমজান মাসে। এ রমজান মাসে সারা দেশেই অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর পাশাপাশি মুড়ির দামও সামান্য বেড়ে থাকে। এবছর পবিত্র রমজান মাসে টেকনাফে প্রতি কেজি মুড়ি ৪৮ থেকে ৫২ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রমজান মাসের পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

২৬ সেপ্টেম্বর মুড়ি খেকোরা বাজারে গিয়ে মুড়ির দাম শুনে ভিষম খাবার অবস্থা। এক লাফে ৭০ টাকা। তাও আবার নাকি দরদাম করার সুযোগ নেই। হায় রোহিঙ্গা, এবার মুড়ির কেজি ৭০ টাকা !

জানা যায়, মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় রোহিঙ্গা নিধন, নির্যাতন ও বসত-বাড়ি অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্থ করার কারণে সীমান্ত জনপদ টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ৫ সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিরুপ প্রভাবে স্থানীয় বাজারে আগুন লেগেছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রা অস্থির হয়ে উঠেছে। শাহপরীরদ্বীপ, নয়াপাড়া, সাবরাং, পৌরসভা, টেকনাফ সদর, বাহারছড়া, হ্নীলা এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হাট-বাজার সমুহ ঘুরে দেখা গেছে গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে একদিকে প্রতিবেশী দেশে সংঘাত ও উত্তেজনার কারণে নাফনদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় বিভিন্ন প্রকার মাছের চাহিদা চরম বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরের মাছ শিকারী ট্রলার সমুহ মাছ শিকারে না গিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাইতে লিপ্ত থাকায় সহজলভ্য হচ্ছে না। তাই যে কোন প্রকারের মাছের দাম এখনো পর্যন্ত চড়া রয়েছে। এছাড়া শুটকী মাইট্টা, পোয়া, ছুরি, ছোট ছোট মাছসহ বিভিন্ন প্রকার শুটকীর দাম প্রতি কেজি ২০০ টাকা হতে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

শুটকী ব্যবসায়ী জয়নাল বলেন ‘এখন আগের মতো মাছ মিলছেনা। অতিরিক্ত গাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি আড়তদারেরা দাম বৃদ্ধি করায় শুটকীর দাম বেড়েছে’। বাহারছড়ার মৌলভী আশরাফ আলী জানান, লোকজন ভয়ে সাগরে মাছ শিকারে যাচ্ছেনা। তার উপরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে মাছ ও শাক-সবজির দাম চড়া। অপরদিকে ২০ টাকার গোল আলু ৭০ টাকা, ১১০ টাকার কাঁচা মরিচ ১৭০ টাকা, ৪০ টাকার বেগুন ৭০ টাকা, ২০ টাকার বরবটি ৮০ টাকা, ৩০ টাকার পেয়াজ ৪৫ টাকা, ২৫ টাকার কঁচু ৪০ টাকা, ৩০ টাকার ঢেঁড়শ ৬০-৭০ টাকা, ৪০ টাকার করলা ৬০ টাকা এবং চাউলের বস্তা প্রতি ১৫০ টাকা হতে ২০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তরিতরকারীর পাশাপাশি এলমুনিয়াম এবং মেলামাইনের তৈজষপত্রসহ যাবতীয় নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে।

শাহপরীরদ্বীপের মাছ শিকারী জেলে কামাল হোছন বলেন ‘এখানকার বাজারে আলু প্রতি কেজি ৭০ টাকা বিক্রি করছে। গরীব মানুষ বেশী কষ্টে আছে’। হোয়াইক্যংয়ের ইসমাঈল ফরিক বলেন ‘নাফনদী ও সাগরের মাছসহ মাংস, শাক-সবজি ও তৈল-মসল্লার দাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। যা সাধারণ মানুষের জীবনে চরম ভোগান্তি বয়ে আনছে’।

এদিকে ভাদ্র মাসে এমনিতেই সাধারণ মানুষের কাজ-কর্ম কমে যাওয়ায় রোজগার নেই। মরার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থা বিরাজমান হওয়ায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনে। হ্নীলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি শেখ মুহাম্মদ রফিক বলেন ‘আজকে চাউলের বস্তা গতবারের চেয়ে ২শ টাকা বেশী নিয়েছে’। চাউল ব্যবসায়ী জাবেদ সওদাগর জানান ‘রোহিঙ্গা অবস্থানের পর হতে টাকা অগ্রিম দিলেও আড়ত হতে গাড়ি ছাড় দিচ্ছেনা। প্রতি গাড়িতে বাড়তি টাকা নিচ্ছে। তাই স্থানীয় বাজারে চাউলের দাম কিছুটা বাড়ছে’। সবজি ব্যবসায়ী হেলাল জানান ‘মালামাল আনতে যানবাহনে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আড়ত হতে দামও বাড়িয়ে নিচ্ছে। তাই স্থানীয় বাজারে শাক-সবজির দাম কিছুটা বাড়ছে’।

স্থানীয় বাসিন্দা লোকজন অভিযোগ করেছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অজুহাতে বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি করে জনজীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছেন। তারা উপজেলা বাজার মনিটরিং কমিটির জরুরী হস্তক্ষেপের দাবী করেন। হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান এইচকে আনোয়ার সিআইপি বলেন ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দ্রব্যমুল্যের দাম বাড়ছে। তা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার’। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাজার মনিটরিং কমিটির সভাপতি জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন ‘বিষয়টি কেউ আমাদের অবহিত করেনি। আপনাদের মাধ্যমে কেবল অবগত হয়েছি। সীমান্তে দ্রব্য মুল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করা হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাফর আহমদ বলেন ‘রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট স্থানে স্থানান্তরিত না হওয়ায় দ্রব্যমুল্যও যানবাহনের ভাড়া চরম বেড়েছে। তাদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গেলে এই সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা করছি’।