সিবিএন ডেস্ক:

গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমনপীড়নকে মানবতাবিরোধী অপরাধ আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংগঠনটি এই পর্যবেক্ষণ হাজির করেছে। হত্যা-ধর্ষণ-উচ্ছেদের বিপুল আলামত পাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪টি ক্ষেত্র শনাক্ত করেছে এইচআরডব্লিউ। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুরুতরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী যে নিপীড়ন চালিয়েছে তা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রগুলো হলো: ক) কোনও জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা, খ)হত্যা, গ)ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সন্ত্রাস এবং ঘ) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাচুর বিবেচনায় নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড করা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ এবং ২০১৬ সালে উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং রাখাইনের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তরা রাষ্ট্রয়ি নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তখনও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য বার্মিজ সরকারকে দায়ী করেছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

আইসিসির রোম স্ট্যাচু এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধ হলো এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যা জেনেশুনেই কোনও বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্তৃত ও কাঠামোবদ্ধ হামলা আকারে পরিচালনা করা হয়। এ ধরনের হামলা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় অথবা সাংগঠনিক নীতির অংশ হতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনি বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী এ হামলা হতে হবে বিস্তৃত কিংবা কাঠামোবদ্ধ, তবে দুটোই হওয়া প্রয়োজন। হামলার বিস্তৃতর মানে হলো ‘অপরাধের মাত্রা কিংবা ঘটনার শিকার মানুষদের সংখ্যা’ এবং কাঠামোবদ্ধ হামলা দিয়ে বোঝায় ‘পদ্ধতিগত পরিকল্পনা’।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানবতাবিষয়ক আইনে বলা আছে মানবতাবিরোধী অপরাধ যে কেবল সামরিক হামলার ক্ষেত্রে হবে তা নয়। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধ সশস্ত্র সংঘাতমুলক প্রেক্ষাপটের মধ্যে কিংবা এর বাইরেও হতে পারে। তাছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধ মানে যে কেবল একটি এলাকার গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা পরিচালনা করা, তা নয়। হিউম্যান রাউটস ওয়াচ মনে করে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বিস্তৃত ও কাঠামোবদ্ধ হামলা চালিয়েছে। পূর্বে স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবিতে দেখা গেছে যে এলাকায় জ্বালাও পোড়াও এর আলামত পাওয়া গেছে তা রাখাইন রাজ্যের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জ্বালাও পোড়াও এর তৎপরতা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

হিউম্যান রাইটসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেরকে স্থানান্তরিত ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করেছে। আইসিসি পূর্ববর্তী সব বড় বড় আন্তর্জাতিক অপরাধের দলিলেই বিতাড়নকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো করেই সে দেশের এই মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে টেলিভিশনে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে দেওয়া অং সান সু চির ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ- এইচআরডব্লিউ স্পষ্ট বিবৃতিতে জানায়, ওই ভাষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে হারানো গ্রহণযোগ্যতা  ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা নিয়েছেন সু চি। তবে বক্তব্যে সু চি দেশের রোহিঙ্গাবিরোধী জনতা এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে গেছেন বলে অভিযোগ তোলে তারা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান  জানায় সংস্থাটি।

এর ক’দিন পরে  মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এখনও বাংলাদেশ সংলগ্ন সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতে রাখছে বলে প্রমাণ হাজির করে এইচআরডব্লিউ। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, স্বাধীন সংবাদকর্মীর প্রতিবেদন আর এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোকচিত্রের  তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা জানায়, গত কয়েক সপ্তাহেও অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। এই মাইনের ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ।  মিয়ানমারকে অবিলম্ব ওই নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করে ১৯৯৭ সালের মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওই আন্তর্জাতিক সংস্থা।