আমান উল্লাহ আমান, টেকনাফ (কক্সবাজার)॥
রাখাইনে সহিংসতার এক মাস পেরিয়ে গেলেও মৃত্যু ভয়ে এখনো পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রাতের বেলায় এসব রোহিঙ্গা এদেশে আসছে। আগের মতো দলে দলে না আসলেও নাফ নদী সীমান্ত পেরিয়ে আসছে শতশত রোহিঙ্গারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নাফ নদ পাড়ি দিয়ে টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে এখনো রোহিঙ্গাদের আগমন বন্ধ হয়নি। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা আগের মতো ঢলে ঢলে না আসলেও প্রতিদিন-রাতে প্রায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা এপারে আশ্রয় নিতে পালিয়ে আসছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, রাখাইন এখনো অশান্ত ও উত্তপ্ত। তাই মৃত্যু ভয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন।
সোমবার বিকালে প্রায় অর্ধশত রোহিঙ্গা টেকনাফ বাস ষ্টেশন এলাকায় অপেক্ষা করছিল অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যাওয়ার জন্য। সোমবার ভোরে শাহপরীরদ্বীপের মিস্ত্রিপাড়া সীমান্ত দিয়ে তারা এদেশে অনুপ্রবেশ করে।
এখানে কথা হয় রাখাইনের মংডু বদুছড়া এলাকার জালাল আহমদ ও বাগঘোনা এলাকার কাউছার পারভিনের সাথে। জালাল আহমদ জানায়, সোমবার ভোরে মা-বোন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ ৬ জন মিস্ত্রিপাড়া সীমান্ত দিয়ে দালালদের মাধ্যমে এপারে আসে। তিনদিন আগে সেনারা বদুছড়া গ্রামে অভিযান চালায়। বাড়ী ঘরে আগুন দেয়। বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে এদেশে আসতে হয়েছে। অবশ্য এর আগে থেকে সেনারা গ্রামের বেশ কিছু লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তারপরও কিছু মানুষ এখনো গ্রামে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে বলে জানায় সে। সীমান্ত পেরোতে জনপ্রতি মিয়ানমার ৩০ হাজার কিয়াত দালাদের দিতে হয়েছে।
সীমান্ত পেরোতে গিয়ে স্বামী-সন্তানকে হারিয়ে ফেলেছে কাউছার :
রাখাইনের বাগঘোনা এলাকার আবদু ছালামের (৬০) স্ত্রী কাউছার পারভীন। সোমবার বিকালে এক সন্তানকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় বসে ছিল টেকনাফ বাস ষ্টেশন এলাকায়। মা, সন্তান উভয়ে ছিল ক্ষুধার্ত অবস্থায়। এসময় স্থানীয় লোকজন কিছু শুকনো খাবার রুটি, কলা, পানি খেতে দিলে গোগ্রাসে খেতে থাকে। কাউছার জানায়, সোমবার সকালে সীমান্ত পার হয়ে স্বামী ও দুই সন্তানসহ এদেশে আসে। সকালে শাহপরীরদ্বীপ হতে টেকনাফ আসতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে বয়োবৃদ্ধ স্বামী ও ওমর ফারুক আড়াই বছরের এক সন্তানকে হারিয়ে ফেলে। দিশেহারা কাউছার পারভীন অপর এক সন্তান সাদিয়া (১) কে নিয়ে কোথায় যাবে জানেনা। সে আরো জানায়, ১০/১২ দিন আগে সেনারা তাদের গ্রামে অভিযান চালিয়ে কয়েকশত বাড়িতে আগুন দেয়। ২০ জনের অধিক লোককে হত্যা করে।
এছাড়া রোববার দুপুরে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চর পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের মংডুর খুইন্যা পাড়া এলাকা থেকে আসে ১৮ জন রোহিঙ্গাবাহী একটি নৌকা। ওই নৌকার রোহিঙ্গা নারী ছলিমা খাতুন (৩৮) জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের গ্রামটি গত চারদিন আগে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। গ্রামটি এখন জনমানব শূণ্য, সেখানে শুধু ধ্বংসস্তুপ আর পোড়া গন্ধ। গ্রামের সবাই আগেই চলে এসেছে, তারা সবশেষ এসেছেন। ওই গ্রামটি এখন রোহিঙ্গা শূণ্য।
ছলিমা জানায়, মিয়ানমারের বর্বর সেনারা তাদের গ্রামের একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে অন্যদের মতো তারাও গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায়। তাদের গ্রামের অন্যরা আগে থেকে বাংলাদেশে চলে আসলেও তারা গত চারদিন মিয়ানমার নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় অবস্থান নেয়। নাইক্ষ্যংদিয়ায় তাদের সাথে অবস্থান করা অন্য রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসলে তারা সেখানে পড়শিহারা হয়ে আরো দু,দিন অপেক্ষা করে।
ওই রোহিঙ্গা নারী আরো জানায়, তারা নাইক্ষ্যংদিয়ায় অবস্থান করে পুনরায় তাদের পোড়া গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ বেলায় এসে দেখে তাদের সেই পোড়া গ্রামে এখনো সেনারা দিনরাত টহল দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ওই গ্রামের সবাই এখন বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তাই তারাও বাংলাদেশ আসতে বাধ্য হয়।
মংডুর গর্জনদিয়া থেকে আসা অন্ত:সত্বা রোহিঙ্গা নারী মদিনা বেগম (৩৫) জানিয়েছেন,নৌকা ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে না পারায় তারা এতোদিন বাংলাদেশ আসতে পারেনি। ওপারের সেনাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ঝোঁপেঝাড়ে খেয়ে না খেয়ে কোন মতে পালিয়ে দিন কাটছিল তাদের। কিন্তু এতোদিনে রাখাইনের পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় দিনমজুর স্বামী রহিম উল্লাহ আত্মীয় স্বজন থেকে ধার করা টাকায় নৌকা ভাড়া দিয়ে তাদের বাংলাদেশ নিয়ে এসেছেন। নৌকার মাঝি তাদের প্রতিজন থেকে ৫ হাজার টাকা করে আদায় করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার রাখাইনে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমন এখনো থামেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ওপার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ রাখাইন এখনো পুড়ছে। তাই অশান্ত রাখাইনে তাদের জীবন অনিরাপদ।