মিয়ানমারে নতুনমাত্রায় নির্যাতন, আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১০:৩৪ , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১০:৪৬

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


নতুন করে এভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। ছবি সোমবারের।

# সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে মিয়ানমার
# পুরোদমে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী
# রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ চরম সংকটে পড়ার আশংকাইমাম খাইর, সিবিএন:
গত ২৪ আগষ্ট মিয়ানমারে শুরু হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এখনো থামেনি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখেও জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করেনি বর্মি বাহিনী। নতুন মাত্রায় শুরু হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতন। পরিস্থিতি বুঝতে এতদিন যারা পাহাড়জঙ্গলে আত্নগোপনে ছিল তারাও পালিয়ে আসতে শুরু করেছে।
রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাত এবং আজ সোমবারও নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৫০ হাজারের বেশি নির্যাতিত নারী, শিশু ও পুরুষ।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, উখিয়ার পালংখালীর আনজুমানপাড়া, হোয়াইক্যং এর কানজরপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, নয়াবাজার বটতলী, জাদিমোরা, শাহপরীরদ্বীপসহ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
তারা এখন বিভিন্ন সড়ক-রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। কোন শিবিরে তাদের ঠাঁই হয়নি। এর আগে ঢুকেছে প্রায় ৫ লাখ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন করে ঢুকলো আরো অর্ধ লাখ। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ চরম সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
আরাকান রাজ্যে অন্তত ১৬ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে। সেখান থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রবিবার রাতে ঢুকেছে ৫০ হাজার। আরো অন্তত ১ লাখ পাইপ লাইনে রয়েছে। এমনটি মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
ষাটোর্ধ নারী লালমতি। স্বামী নজু মিয়া। পরিবারের ৭ সদস্য নিয়ে রবিবার রাতে হোয়াইক্যং সীমান্তের আনজুমানপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। লালমতির বাড়ী মংডুর দক্ষিণ পাড়ায়। তিনি জানান, বর্মি বাহিনীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে তারা এত দিন দেশ ত্যাগ করেনি। ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল পাহাড়ে। সেখানেও থাকতে পারেননি। পাহাড়ে গিয়ে তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। দেশ ছাড়তে হুমকি দেয় বর্মি অস্ত্রধারীরা। অবশেষে জীবন বাঁচাতে তারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তিনি জানান, আসার সময় তাদের পরিবারের ১১ সদস্য ছিল। সেখান থেকে ৪ জন কোথায় গেছে তিনি জানেননা। তবে লালমতির আশংকা, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। লালমতি গুরুতর অসুস্থ। তাকে বালুখালী পানবাজার এলাকার একটি ক্যাম্পে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দলবেঁধে পালিয়ে আসেন মিয়ানমারের বুথিদং এলাকার একটি স্কুল শিক্ষক নজির আহমদ। তিনি জানান, ২৫ আগে তারা ঘর থেকে বের হন। এতদিন বিভিন্ন পাহাড় জঙ্গলে তাদের সময় কেটেছে। তাদের সাথে প্রায় সাড়ে ৪শ পরিবার ছিল। আসার থেকে ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমার সৈন্যরা।
বুথিদং এলাকা থেকে রবিবার রাতে পালিয়ে আসা হাফেজ ছৈয়দ আহমদ নামে মাদরাসার শিক্ষক জানান, বর্মি বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করার মতো নয়। ধর্মীয় নেতাদের থানায় ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। কয়েক দিন আগে কয়েকজন আলেমকে সেনা ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে মগ সেনারা।
নাজমা বেগম (১৯) রবিবার শেষ রাতে এসেছেন স্বামীর সাথে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের মংডুর নয়া পাড়া থেকে। স্বামীর সাথে তিন সন্তান নিয়ে প্রবেশ করেছেন। নাজমা বেগম আবারো সন্তান সম্ভবা।
তিনি এ প্রতিবেদককে জানালেন, স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। মিলিটারিরা হত্যা-নির্যাতন না করলে তারা এখানে আসতেন না।
হাফেজ যাকারিয়া (২৭) প্রাণভয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলে এসেছেন।
তিনি জানান, একদিন এশার নামাজের পর আমাদের এলাকার প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা আহমদ কবিরও মাওলানা জয়নাল আবেদীনকে মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। দুই দিন পর তাদের গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়।
হাফেজ যাকারিয়া জানালেন, ওই প্রসিদ্ধ দুই মাওলানাকে মেরে ফেলার পর আমরা আর সেখানে থাকা নিরাপদ মনে করিনি। প্রাণভয়ে হাতের কাছে যা পেয়েছি তাই নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি। বনে-জঙ্গল দিয়ে এসেছি। মিলিটারির দিকে নজর রেখেছি একই সাথে রাখাইনদের থেকে দূরে থেকেছি। এই দুইটা জাত আমাদের মেরে ফেলতে চায়।
সোমবার সকালে অথবা এর আগের দিন রবিবার যারা বাংলাদেশে নতুন করে প্রবেশ করেছেন, এদের সবারই একই অবস্থা। বন-জঙ্গলে, পাহাড়ে হাটতে হাটতে অনেকেই নানাভাবে জখম হয়েছে। এখানকার রাস্তা-ঘাট না চেনার কারণে এবং ভাষাগত সমস্যার কারণে এরা চিকিৎসা পাচ্ছে না। এরা শুধুমাত্র কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষাটাই বোঝে। এরা শুদ্ধ বাংলা একেবারেই বুঝতে পারে না। ফলে চিকিৎসা নিতে গেলে সুচিকিৎসাটাও পাচ্ছে না। অনেক সময় স্থানীয় লোকজনকে সাথে নিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
গত ১৫ দিন উখিয়ার বালুখালীর পানবাজারে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনা করছেন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
তিনি জানান, ভাষাগত একটা সমস্যা আছে। স্থানীয় লোকজনকে সাথে নিয়ে আমরা এদের চিকিৎসা দিচ্ছি। ভাষাটা বুঝতে পারলে রোগী সঠিক চিকিৎসাটা পাচ্ছে।
তিনি জানান, দীর্ঘ দিন বনে জঙ্গলে অবস্থান করে এরা সর্দি-কাশি, ঠা-া, রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, ডায়রিয়া, আমায়শয়ে ভুগছে।
সুত্রগুলো জানায়, উখিয়া, টেকনাফসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করা এসব নির্যাতিত অনেকেই ফেলে এসেছেন আপনজনদের। তাদের বেশির ভাগই ১৫-১৬ দিন আগে মিয়ানমারের আর্মি, পুলিশ ও স্থানীয় মগদের ভয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এরা ধীরে ধীরে মিয়ানমার বাহিনীর নজর এড়িয়ে বাংলাদেশের দিকে হেটেছেন। হাটতে হাটতে গতকাল রোববার শেষ রাতে এবং আজ সোমবার সকালে নাফ নদী অতিক্রম করে প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশে।সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে মিয়ানমার:
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে থাকা কাঁটাতারের বেড়া পুনরায় মেরামত করছে মিয়ানমার। গত তিন দিন ধরে তারা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে ক্ষতিগ্রস্ত কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে। সোমবারও (২৫ সেপ্টেম্বর) নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম, তমব্রু ও জলপাইতলী সীমান্তে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করতে দেখা গেছে।
মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্ত ঘেঁষে তাঁবু তৈরি করে শ্রমিক নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করা হচ্ছে। সীমান্তের যেসব পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া ক্ষতিগ্রস্ত করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে মূলত সেসব পয়েন্টগুলোয় মেরামত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে লাগোয়া সীমান্ত পিলারও পরিবর্তন করা হচ্ছে। যাতে করে কোনও রোহিঙ্গা ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্তে বসবাসকারী রাহামত উল্লাহ, সাদেক মিয়া ও ফজল আহমদসহ অনেকে জানিয়েছেন, গত তিন দিন ধরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে। এসব কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আসছে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে।
তারা বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানামারে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্তে তাদের তৎপরতা বেশি দেখা যাচ্ছে। যেসব স্থানে কোনও দিন বিজিপি আসেনি এখন সেসব স্থানেও তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু সীমান্তের ছরার পাশ ঘেঁষে নো-ম্যানস ল্যান্ডে গড়ে উঠেছে একটি ছোট রোহিঙ্গা বস্তি। ওই বস্তিতে থাকা রোহিঙ্গা নাগরিক আব্দুল মতলব, ছৈয়দ আলম, কালো মিয়া, মরিয়ম বেগম, ফাতেমা জানান, রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলো এখন সবই ফাঁকা। সেখানে কোনও বসতিতে মানুষ নেই। যা কিছু লোক এখনও রয়েছে, তারাও বিভিন্ন ঝোঁপজঙ্গলে লুকিয়ে আছে। এ কারণে আর কোনও রোহিঙ্গা যাতে মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারে সে ব্যাপারে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া মেরামত, বিভিন্ন প্রবেশদ্বারে স্থল মাইন পুঁতে রাখা ও আকস্মিকভাবে সীমান্তে টহল জোরদারসহ নানা কার্যক্রম করে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গারা জানান, সীমান্তের খুব কাছে অবস্থান নেওয়ার একটি উদ্দেশ্য ছিল যেন রাখাইনের পরিস্থিতি সামান্য শান্ত হলে তারা দেশে ফিরে যাবেন। তাদের কারও কারও বাড়ি সীমান্তের এক থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। এমনিতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে তারা দিনে একবার হলেও নিজের ক্ষতিগ্রস্ত বসতিগুলো দেখতে যেতো। আর এখন কাঁটাতারের বেড়া আরও মজবুত করায় সেটি আর সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, ‘মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করছে সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেখানে আমাদের কোনও হস্তক্ষেপ নেই। তবে আমরা আমাদের সীমান্তে খুব সতর্কাবস্থায় আছি। সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্ট সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে।’
বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্তপথ রয়েছে ২৭১ কিলোমিটার। এরমধ্যে ২০৮ কিলোমিটার স্থলপথ ও ৬৩ কিলোমিটার জলসীমান্ত। পাঁচ বছর আগে থেকেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরের অধিকাংশ সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে সেদেশের সরকার।পুরোদমে কাজ শুরু করেছে সেনা বাহিনী:
মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে দ্রুত মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে শনিবার থেকে সেনাবাহিনী পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৮টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তিনটি ধাপে এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। প্রাথমিকভাবে তারা সব উৎস থেকে ত্রাণ সামগ্রী গ্রহণ ও নির্দিষ্ট স্থানে গুদামজাত করছে। পরবর্তীতে ত্রাণ সামগ্রী প্যাকেট করে গুদাম থেকে বিভিন্ন বিতরণ স্থানে পরিবহন করা হচ্ছে। সর্বশেষে তালিকা অনুযায়ী সমভাবে দুর্গত রোহিঙ্গাদের মাঝে তা বিতরণ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় রান্না করা খাবার বিতরণ কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ কল্পে ও সেনাবাহিনীকে মাস্টারপ্ল্যান ও ডিজাইনসহ অন্যান্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দ্রুত এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে আশ্রয় কেন্দ্রসমূহ নির্মাণকাজ শুরু হবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ও রোহিঙ্গাদের মাঝে চিকিৎসা কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
সড়কে গাড়ি থামিয়ে কোন ধরনের ত্রাণ বিতরণ না করার নির্শনা দিয়ে ব্যানার টাঙানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে গঠিত টিম এবং সেনাবাহিনী বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করছে।
অহেতুক রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে যাতে গাড়ি নিয়ে কিংবা জটলা নিয়ে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সেই বিষয়টিও মনিটরিং করছে সেনাবাহিনী। উখিয়া কলেজ গেটের সামনে দিয়ে গাড়ি প্রবেশের সময় বিজিবি, সেনাবাহিনী এবং পুলিশের জিজ্ঞাসা ও তল্লাশির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সড়কে যানবাহন চলাচল যাতে সুশৃঙ্খল থাকে সেই ব্যবস্থাপনায়ও পুলিশের সঙ্গে সেনা সদস্যদের দেখা গেছে। এই অবস্থায় বড় ধরনের শৃঙ্খলা ফিরেছে ত্রাণদাতাদের কার্ক্রমে।  সুত্র বাংলাট্রিবিউনের।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা অধ্যূষিত বিভিন্ন এলাকায় দুযোর্গকালীন মানবিক সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীকে সংযুক্ত করা হয়েছে। শুক্রবার থেকে সেনাবাহিনী প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। শনিবার থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হয় তাদের। তারা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনে কাজ করছেন। এ বিষয়ে রবিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের সভায় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, সেনা ক্যা¤েপর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার এস.পি, জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা, জেলা জাসদের সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুলসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগষ্ট রাতে মিয়ানমারের কয়েকটি সেনা ও পুলিশের চৌকিতে রোহিঙ্গা জঙ্গি হামলার অভিযোগে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। হত্যা, ধর্ষণের পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বর্তমানে সাড়ে চার লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কুতুপালং, বালুখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঘটে হতাহতের ঘটনা। এসব প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু সামাজিক সংগঠনগুলো সেনা বাহিনীর হাতে দায়িত্ব দেয়ার আহবান জানায়।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অংসান সুচির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৫শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি। রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেও তারা রাজি নয়।
রোহিঙ্গাদের এই স্রোত ঠেকাতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মতো কোনো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। এছাড়া সীমান্তে যৌথ টহলেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই মিয়ানমারের সাড়া মেলেনি। উল্টো তাদের অভিযান সঠিক বলে দাবী করে বিবৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকান্ড শুরু করে।