‘হা লং বে’ থেকে লিখছি

-আবু তাহের

২০১২ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে পেছনে ফেলে বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চার্য প্রতিযোগিতায় স্থান করে নিয়েছিল ভিয়েতনাম এর ‘হা লং বে’। শেষ মুহুর্তে প্রতিযোগিতার দৌড় থেকে কক্সবাজার ছিটকে পড়েছিল বলে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতের তুলনায় হা লং বে’র সৌন্দর্য কি এতই বেশী। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- ‘তোর সোনা অঙ্গে কত রূপ’- আমাকে দেখতে হবে। অবশেষে সেই সুযোগ হয়ে গেল।

এখন এই লেখাটি যখন লিখছি হা লং বে’র উপর বসে। একই সাথে এখানে রাতের সৌন্দর্যও উপভোগ করছি। সত্যিই অপূর্ব। সৃষ্টিকর্তা সব সৌন্দর্য যেন ঢেলে দিয়েছে হা লং বে উপর। আজকের রাতটি এখানে কাটিয়ে দেব জাহাজের একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। জাহাজ না বলে এটিকে তিন তারকা মানের একটি হোটেল বলতে হবে। হা লং বে’র উপর ভাসমান নানা মানের নানা ধরণের কয়েক’শ জাহাজ হোটেল রয়েছে। এখানে রয়েছে পাঁচ তারকা মানের হোটেলও। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চার্য দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসছে এখানে। এই জাহাজে চড়ে তারা দিনের সৌন্দর্য যেমন দেখছে, রাতের সৌন্দর্য উপভোগ না করে এখান থেকে যেতে চায় না। ভিয়েতনামের এই গ্রীষ্মকালেও ভাসমান হোটেলের কোন কক্ষ মনে হয় খালি যায় না।

হা লং বে’র শান্ত শীতল জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইম পাথরের তৈরি অসংখ্য পাহাড়। জঙ্গল আচ্ছাদিত সারি সারি সবুজ পাহাড় নীল জলের বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক যেন থাইল্যান্ডের পিপি আইল্যান্ড। তবে আয়তনে এটি বিশাল। পর্যটকদের দুর্নিবার আকর্ষণ এবং এর ব্যবস্থাপনা এই পর্যটন কেন্দ্রকে ইউনেস্কো বিশ্ব হ্যারিটেজ ঘোষনা করেছে। হা লং বে আয়তনে প্রায় পনের’শ বর্গ কিলোমিটার। এই সমুদ্র পর্যটকদের জন্য যেমন আকর্ষনের, তেমনি জেলেদের জন্যও কম আকর্ষনের নয়। এখানে ৪টি জেলে পল্লীতে প্রায় ২ হাজার জেলে মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত। পর্যটকদের বোটের সাথে জেলে নৌকাগুলো ভাসছে। নৌকার আলো যেন জলের সৌন্দর্যকে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে।

দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে সাধারণত ভ্রমন প্যাকেজ গুলো নিতে আগ্রহী হই না। আমি আমার মত করে ঘুরব, দেখব, উপভোগ করব- এই নীতি মেনে চলি। কিন্তু হা লং বে দেখার জন্য কৌতুহলী হয়ে একটি ভ্রমণ প্যাকেজ নিয়ে নিলাম। দুই দিন এক রাতের জন্য তারা আমার কাছ থেকে নিয়েছে দু’শ ডলার। বলেছে এটি তিন তারকা মানের হোটেলের সমান ভ্রমন প্যাকেজ। অবশ্য এক’শ দেড়’শ ডলারে আরো অনেক ভ্রমন প্যাকেজ রয়েছে। রয়েছে লাখ টাকা দামের পাঁচ তারকা মানের প্যাকেজও। সকাল ৮টায় হ্যানয় এর একটি হোটেল থেকে তারা আমাকে তুলে নিয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিনি বাসে রয়েছে আরো কিছু পর্যটক। যাদের প্রায় সবাই বিদেশী। রাজধানী হ্যানয় থেকে ১৭০ কিলো মিটার দুরে হ্যা লং বে সিটি। বাসে সাড়ে ৩ ঘন্টার পথ। পথে আমাদের যাত্রা বিরতি দেয়া হল একটি বিশাল প্রদর্শনী কেন্দ্রে। যেখানে ভিয়েতনামের মেয়ে শিল্পীরা সুই সূতা দিয়ে কাপড়ের উপর শিল্পকর্ম তৈরি করছে। সত্যিই অপূর্ব এই শিল্প কর্ম। দুই ফুট বাই দুই ফুট একটি শিল্পকর্ম তৈরি করতে নাকি তাদের এক মাসের বেশি সময় লাগে। এর জন্য এই শিল্প কর্মের দামও অনেক বেশি। ছোট সাইজে সর্বনি¤œ ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ কয়েক লাখ টাকা দামেরও শিল্পকর্ম রয়েছে। এই নারী শিল্পীদের যদি দেয়া হয় পিকাসো’র আঁকা একটি ছবি। রং তুলিতে আঁকা সেই ছবি তারা সুই সূতা দিয়ে কাপড়ের ক্যানভাসে অবিকল তৈরি করে দেবে। সুই সূতার এমনই দক্ষ শিল্পী ভিয়েতনাম ছাড়া আর কোথাও নাকি হয় না। অবশ্য পাথর কেটে তৈরি ছোট বড় অনেক ভাস্কর্যও এখানে বিক্রি হচ্ছে। রয়েছে অলংকার থেকে স্যুাভেনির, প্রসাধনী, কাপড় আরো অনেক কিছু। মন টানছে হা লং বে। তাই শিল্প কর্মের সৌন্দর্য বাদ দিয়ে বাস-এ উঠে বসলাম। এবার এক ঘন্টার মধ্যে হা লং বে। বাস থেকে নেমেই উঠলাম জাহাজে। বেলা ১২টার মধ্যে চেক ইন। রুমে ঢুকেই চমৎকৃত হলাম। সত্যিই ৩ তারকা মানের হোটেল।

জাহাজে উঠার সাথে সাথে আমাদের দেয়া হয় শীতল জুসের সাথে উঞ্চ অভ্যর্থনা। একটু পরেই বিশাল ডাইনিং কক্ষে দুপুরের খাবার। জাহাজ চলছে সমুদ্র ও পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এঁেক বেঁকে। নীল জলে মাথা তুলে চার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়। একদিকে ডাইনিং টেবিলে অর্ধশত আইটেমের খাবার, অন্যদিকে প্রকৃতির সপ্তম আশ্চর্যের নয়ন ভুলানো রূপ। কোনটা রেখে কোন ধরি। বেঁচে থাকলে খাবার অনেক হবে, আর সৌন্দর্য দেখা হয়ত হবে না। তাই তড়িঘড়ি ক্যামেরা হাতে উঠে গেলাম জাহাজের ছাঁদে। ছবির ভারে আমার ক্যামেরার ধারণ ক্ষমতা উপচে পড়ে।

খানিক বাদে আমাদের নামিয়ে দেয়া হল একটি পাহাড়ের পাদদেশে জেটিতে। প্রদর্শকের (গাইড) পেছনে পেছনে সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকলাম পাহাড়ের উপরে। কিছু দূর গিয়ে পাওয়া গেল একটি গুহা। হাজার হাজার পর্যটক সেই গুহার পেটে হজম হয়ে যাচ্ছে। আমিও ঢুকে গেলাম। প্রথম গুহা তত বড় নয়। সুড়ঙ্গ পথ ধরে কিছুটা গেলে পাওয়া গেল আরও একটি গুহা। এটি মাঝারি আকারের। সেই গুহা শেষ করে সরু পথ ধরে আরও কিছুটা উপরে উঠলে আমার বিস্ময়ের সীমা নেই। বিশাল আর একটি গুহা এই পাহাড়ের ভিতরে। হাজার হাজার মানুষ এখানে গুহার সৌন্দর্যে মোহিত হচ্ছে। পাহাড়ের ভিতরে শীতল একটি পরিবেশ। সেই সৌন্দর্য ‘হা লং বে’ কে করেছে আরো মহিমান্বিত। পাহাড়ের উঁচু নিচু কয়েক’শ ফুট গুহা পথে পায়ে চলার কষ্ট কিছুই নয়, এই সৌন্দর্যের কাছে। গুহা থেকে বের হয়ে ফের উঠলাম জাহাজে। কিছু দূরে গিয়ে এবার আমাদের নামিয়ে দেয়া হল অন্য একটি পাহাড়ের নিচে মনোরম ছোট্ট সৈকতে। হাজার হাজার পর্যটক এখানে জলে অবগাহন করছে। কেউ বালিতে খেলছে ফুটবল। কেউ পাহাড়ে উঠার দড়ি ও যন্ত্রপাতি নিয়ে লেগে গেছে ‘হাইকিং’ করতে। একটি পাহাড় নিয়ে ছোট্ট এই দ্বীপের নাম ‘টি টপ আইল্যান্ড’। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে সোভিয়েত এক বীর যোদ্ধা জেনারেলের নামে এই দ্বীপের নামকরণ। এখানে এক একটি পাহাড়কে এক একটি দ্বীপ গণ্য করা হয়। সন্ধ্যা নেমে আসলে জাহাজে ফিরলাম। রাতের ডিনার শেষ করে জাহাজের ছাদে বসে থাকলাম দীর্ঘক্ষণ। মধ্যরাত পার করে রুমে গিয়ে জানালা খুলে দিলাম। বাইরে এমন মুগ্ধ করা পরিবেশ, ঘুম আসতে চায় না। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। এসেছিলাম ব্যাংকক এ চিকিৎসা করতে। সেই ফাঁকে ভিয়েতনাম ঘুরে দেখা। হা লং বে’র স্বচ্ছ জলের উপর দিন ও রাতের সৌন্দর্য উপভোগ। এমন বিশ্রাম আর কখনও কি আমার ভাগ্যে জুটবে, জানি না।

সকালে সোনালী রোদ চোখে ঝাপটা দিলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রুমের বাইরে এসে দেখি। হা লং বে’র এই সৌন্দর্য অন্যরকম। নাস্তা শেষ হলে আমাদের নিয়ে গেল মুক্তার একটি খামারে। সমুদ্রের তলদেশে ঝিনুকের চাষ করে কিভাবে মুক্তা তৈরি হচ্ছে এখানে আমাদের দেখানো হল। দেখানো হলে মুক্তা চাষের বিভিন্ন ধাপ। তাজা ঝিনুক কেটে মুক্তাও বের করা হল। এরপর বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেল। সে এক এলাহি কারবার। আমাদের দলে মেয়ে পর্যটক যারা রয়েছেন তাদের অবস্থা সত্যিই দেখার মত। এক একটি মুক্তার মালার দাম সর্বোচ্চ ত্রিশ লাখ টাকা পর্যন্ত। কেনার সামর্থ ক’জনের রয়েছে। আসল মুক্তার এমন সৌন্দর্য আমার আর কখন দেখা হয়নি। হা লং বে শুধু রূপের সৌন্দর্য নিয়ে নয়, তার মূল্যবান সম্পদ মুক্তা নিয়েও অহংকার কম নয়।

এবার আমরা গেলাম পাশের অন্য একটি ছোট্ট দ্বীপে। এখানে ‘কাইয়ক’ বোট ভাড়া ভাড়া দেয়া হচ্ছে। ছোট ডিঙ্গি নৌকায় একাকি অথবা জোড়ায় জোড়ায় পর্যটকরা চড়ে বসছে। হা লং বে’তে এসে কাইয়ুক বোটে চড়ব না তা কি করে হয়। একটি বোট নিয়ে দাঁড় টানা শুরু করে দিলাম। মনে হচ্ছে সেই শৈশবে ফিরে গেছি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই শৈশবের মত ফের নৌকা চালানো। এক ঘন্টা কিভাবে পার হল বুঝতে পারলাম না। গাইডের মধুর আহবানে জাহাজে ফিরতে হল। গোসল সেরে ডাইনিং রুমে আসতেই দেখি খাবারের এলাহি সম্ভার। এরা পর্যটকদের খুশি করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে। এদের কাছে প্রত্যেকটি পর্যটক অতি গুরুত্বপূর্ণ (ভিভিআইপি) মেহমান। আসলে একটি পর্যটন কেন্দ্রকে আকর্ষনীয় করা যায় তার ব্যবস্থাপনা ও সেবা দিয়ে। এখানে সরকারের ব্যবস্থাপনা অতি উন্নত মানের। যাঁরা পর্যটনে বিনিয়োগ করেছে এবং যাঁরা সেবা দিচ্ছে তাদের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এখানে সরকার শুধু নিজে ব্যবসা করে না, ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করে। তাই হা লং বে আজ বিশ্ব হ্যারিটেজ। লাখ লাখ পর্যটক ছুটে আসছে এখানে। রূপ থাকলে হয় না, রূপের কদরও থাকতে হয়। উপস্থাপনার গুণে রূপের সেই কদর বহুগুণে বৃদ্ধি করা যায় হা লং বে তার প্রকৃষ্ট উদাহারণ।

জাহাজ বন্দরের দিকে যাত্রা করেছে। আমরা খাবারের অপূর্ব স্বাদ নিচ্ছি। সেই সাথে শেষ বারের মত নয়ন ভরে উপভোগ করছি হা লং বে’র অপার সৌন্দর্য। আমাদের দলে কেউ কেউ ভিন্ন জাহাজে উঠে ভিন্ন পথে যাত্রা করেছে। তারা হা লং বে’র সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে আরো কয়েকটি দিন এখানে কাটাবে। এখানে রয়েছে আরো অনেক মনোমুগ্ধকর পর্যটন কেন্দ্র। রয়েছে পর্যটকদের জন্য নানা বিনোদন ব্যবস্থা। বিখ্যাত বানরের দ্বীপ সহ আরোূ কত কি দ্বীপ। সব দেখার সময় আমার হচ্ছে না। তাই ফিরতি জাহাজে বন্দরে নামলাম। আমাদের তোলা হল লিমোজিন ডেকার মিনি বাস-এ। এই বাস যাত্রাও কম আরামদায়ক নয়। সন্ধ্যায় ফিরেছি হ্যানয় শহরে। পেছনে কি যেন হারিয়ে এসেছি। বার বার মন ছুটে যাচ্ছে সেই পেছনের দিকে। ভাবছি- আবার কখনও কি হা লং বে দেখা হবে। নাকি মধুর সেই স্মৃতি নিয়ে থাকব বাকি জীবন।

## এই লিখা নিয়ে কোন মন্তব্য থাকলে ই-মেইল করতে পারেন।

abutahercox@gmail.com