বিদেশ ডেস্ক:
রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞের অভিযোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে রয়েছে অং সান সু চি’র নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার। সু চি’র হাত ধরে কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিপুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের প্রত্যাশা করেছিল দেশটি। তবে রাখাইনে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ও রোহিঙ্গা সংকটের কারণে অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি মিয়ানমারে বিনিয়োগ করা থেকে পিছু হটছে।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার হওয়ার পর বিপুল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের আশা করেছিল মিয়ানমার। বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহও দেখা গিয়েছিল। তবে রাখাইন রাজ্যে শোচনীয় মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে অনেক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানই পিছু হটছে। মিয়ানমারে বিনিয়োগ করলে সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা করছে এসব আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো।

প্রতিবেদন অনুসারে, মিয়ানমার সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করে থাকে চীনের সঙ্গে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, জাপান এবং ভারতও মিয়ানমারের বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। অতীতে মিয়ানমারের ওপর যে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল তাতে এই পাঁচ দেশের কেউই অংশ নেয়নি। তবে দেশটিতে পশ্চিমা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। অবশ্য চলতি বছর কয়েক ধাপে সংস্কার আনার পর দেশটি আশা করছিল এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় থমকে যাওয়া অর্থনীতির দুয়ার খুলবে এবং সামরিক শাসনের আওতায় কয়েক দশকের অব্যবস্থাপনার অবসান হবে। মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের কর্মকর্তারা গত জুনে যখন ছয়টি ইউরোপীয় দেশ সফরে গিয়েছিলেন তখন পরিবহন, জ্বালানি ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ জোরদার হওয়ার আশা করছিলেন তারা। এখন আন্তর্জাতিক অবরোধগুলোর বেশিরভাগই তুলে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে পশ্চিমা মুদ্রার বন্যা বয়ে যাওয়ার যে আশা করা হচ্ছে তা সু চি’র গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা না বলার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মধ্যে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি। আইনজীবী, পরামর্শক ও লবিস্টদের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানায়, ইউরোপীয় ও মার্কিন কোম্পানিগুলো এখন মিয়ানমারে বিনিয়োগে সুনামহানি হবে বলে আশঙ্কা করছে।

ইয়াঙ্গুনভিত্তিক বিনিয়োগ ফার্ম ফেয়ারক্যাপ পার্টনারস-র ম্যানেজিং প্রিন্সিপাল লুই ইয়ুং জানান, তাদের ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে একটি মার্কিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি মিয়ানমারে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত করেছে। তিনি বলেন, ‘ওই কোম্পানিটি মনে করছে এখনই বিনিয়োগ করার সঠিক সময় নয়। তারা সরকারের কাছ থেকে আরও আকর্ষণীয় সুযোগ দেওয়া হয় কিনা তা দেখতে চায়। রাখাইন পরিস্থিতিও বিনিয়োগে সহায়ক নয়।’

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক মাসে মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী ও বিনিয়োগে আগ্রহী কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ জোরালো হয়েছে। এএফডি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বিদেশি ফার্মগুলোকে মিয়ানমারে বিনিয়োগ না করার আহ্বান জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক জ্বলানি কোম্পানি শেভরনের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি দল বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রস্তাব করেছিল, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় তেল ও গ্যাস ফার্মের সঙ্গে করা শেভরনের চুক্তিটি যেন বাতিল করা হয়। নরওয়েভিত্তিক টেলিকম কোম্পানি টেলিনর মিয়ানমারে একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। এ প্রতিষ্ঠানটিও মিয়ানমারে মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের বিনিয়োগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে শেভরন। বার বার চেষ্টা করেও টেলিনরের কাছ থেকে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছে বার্তা সংস্থাটি।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৪০০ মিলিয়ন ডলার। মিয়ানমারে মোট বিনিয়োগের ০.৫ শতাংশ পূরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ। দেশটিতে ইউরোপের বিনিয়োগের পরিমাণ এক দশমাংশ। চীন ও হংকং মিলে মোট বিনিয়োগের এক তৃতীয়াংশই পূরণ করে ফেলে। আর অন্য এক তৃতীয়াংশ পূরণ করে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কমিটি অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড-র প্রধান বার্নড লানগে বলেন, গত সপ্তাহে তার প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি সফর স্থগিত করেছে। কেননা, বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-মিয়ানমার-র সম্ভাব্য বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা করা যাচ্ছে না।

মিয়ানমার ট্যুরিজম ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান খিন অং তুন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যেসব আন্তর্জাতিক ফার্ম মিয়ানমারে সম্মেলন করতে চেয়েছিল তারা এখন স্থান পরিবর্তনের কথা ভাবছে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) নিক্কেই এশিয়া রিভিউতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অং সান সু চি স্বীকার করেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেন, দারিদ্র্যপূর্ণ রাখাইনের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করার অন্যতম চাবিকাঠি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তার দাবি, রাখাইনের পরিস্থিতি উন্নয়নে বিনিয়োগ একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।