ডেস্ক নিউজ:

মারজান বিবি। বয়স ৬৫। অপলক দৃষ্টিতে নাফ নদীর ওপারে জ্বলতে থাকা একটি গ্রামের দিকে তাকিয়ে। আগুনের লেলিহান শিখা নাফের এপার থেকেও দেখা যাচ্ছিল। উপরে আকাশের মেঘের সাথে মিশে যাচ্ছিল ধোঁয়ার কুণ্ডুলি। সেই বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার পর খাঁটি চট্টগ্রামের ভাষায় পুড়তে থাকা সেই এলাকাটা দেখিয়ে বললেন, সেখানে তাদের বাড়ি। নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন তার স্বামী। সেখানেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাখাইন মগরা এক কোপে তার মাথা ফেলে দিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে নৌকায় করে চলে আসলেন নাফের এপারে। বৃদ্ধা মারজান বিবি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তার কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আর বোরকার নেকাবের ওপর দিয়েও দেখা যাচ্ছিল, দু’চোখ বেয়ে নামছে অশ্রুধারা।

নাফ তীরে গেলে আপনি এমন হাজার হাজার, কখনও সেটা লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে- মারজান বিবিদের দুর্দশার কাহিনী শুনতে পাবেন। তাদের ওপর কতটা নির্মম নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী- সে সব কাহিনী শুনতে গেলে আপনাতেই চোখের পানি দু’পাশের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকবে।

উখিয়ার কুতুপালংয়ে একজন বৃদ্ধের গল্প শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না। দুটি সন্তানকেই চোখের সামনে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী- গলা কেটে, ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে। কুতুপালংয়ের আশ্রয় শিবিরে এসে ছোট্ট একটি ঝুপড়ি জুটেছে তার কপালে; কিন্তু সন্তানের শোকে দু’দিন যাবত মুখে কোনো খাবারই তুলতে পারছেন না। শোকে বলতে গেলে পাথরই হয়ে গেছেন।

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (বর্তমানে রাখাইন রাজ্য) কয়েক দশক ধরেই রোহিঙ্গা নিধনে মেতে রয়েছে সেখানকার সেনাবাহিনী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু ও রাখাইনরা। গত বছর অক্টোবরে একবার রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল মিয়ানমার। টানা কয়েকদিনের নৃশংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। হাজার হাজার রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।

তবে এবার আগস্টের শেষ দিকে আরাকানে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা, তা পৃথিবীর যে কোনো নির্মম নৃশংসতাকে হার মানাতে বাধ্য। গুলি-বোমার সঙ্গে ছুরি-তলোয়ার দিয়ে শিশু-তরুণ-যুবকদের ওপর নৃশংস হামলা করে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমার সরকারই কয়েকদিন আগে স্বীকার করেছে, রাখাইনে ১৭৬ গ্রাম মানুষশূন্য। সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেভাবে হত্যা, নির্যাতন আর আগুনের চিত্রগুলো ফুঠে উঠেছে, তা এক কথায় ভয়াবহ।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত নিধনে নেমেছে রাখাইন রাজ্যে। একজন মুসলিমও যেন সেখানে থাকতে না পারে সে লক্ষ্যেই এমন নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আপাত দৃষ্টিতে যেটা দেখা যাচ্ছে- রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি দাবি করে তাদেরকে এ দেশে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য এমন কাজ করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে এর পেছনে আরো কোনো গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।

মিয়ানমার সন্ত্রাসীদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের মত রোহিঙ্গা ছুটে আসছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘ বলছে, এবারের সহিংসতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটা ইতিমধ্যে চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে এসে। টেকনাফের শাহপরির দ্বীপ রোহিঙ্গা প্রবেশের মূল কেন্দ্র। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা, তাদের আগমণ এবং বাংলাদেশে এসে তাদের আশ্রয় দেখতে গিয়েছিলাম শাহপরির দ্বীপে।

ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার পরই দেখলাম কয়েকটি বাস এবং ট্রাকে করে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। চট্টগ্রামের পর কক্সবাজার রুটে দেখা গেলো ত্রাণবাহী বাস এবং ট্রাকের সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। উখিয়া, শাহরির দ্বীপ এসব ত্রাণবাহী যানবাহনের গন্তব্য।

টেকনাফ থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দুরে শাহপরির দ্বীপ। তবে ১০ কিলোমিটারের মত যাওয়ার পর আর গাড়ি এগুবে না। কারণ, রাস্তার অবস্থা ভালো নয়। সে সঙ্গে সেখানে প্রচুর গাড়ী। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ নিয়ে আসা বাস-ট্রাক এবং ব্যক্তিগত গাড়ির মিছিল সেখানে। একই সঙ্গে স্রোতের মত এসে নামতে থাকা রোহিঙ্গা ঢল শুরু মূলতঃ সেখান থেকেই। জায়গাটার নাম হাড়িয়াখালি। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে যতই এগুচ্ছি, হাজার হাজার রোহিঙ্গার মিছিল।

শুধুমাত্র রোহিঙ্গা বললে ভুল হবে। মিছিলের ৯৫ ভাগ মানুষ নারী, শিশু আর বৃদ্ধ। সক্ষম পুরুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তারা কোথায়? রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ে কী যুবক-তরুণ নেই? এমনকি কিশোর বয়সী কোনো ছেলেকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল- মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলার মূল টার্গেটই চ্ছে যুবক-তরুণরা। তাদেরকে দেখামাত্র গুলি করে। ধরে নিয়ে যায়। জবাই করে, পুড়িয়ে মেরে, কিংবা কুপিয়ে যখম করে এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে বর্বর মিয়ানমার বাহিনী এবং রাখাইনরা।

হাড়িয়াখালি থেকেই দেখা যায় নাফের ওপারে মিয়ানমার, রাখাইন রাজ্য। নদীর পাশের গ্রামগুলো জ্বলছে। দৃষ্টিসীমা যতদুর যায় ততদুর আগুনের লেলিহান শিখা। ধোয়ার কুণ্ডুলি মিশে যাচ্ছে আকাশে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত যতক্ষণ হাড়িয়াখালি এবং শাহপরির দ্বীপে ছিলাম, ততক্ষণ দেখলাম নাফ নদীর পাড়ের লোকালয়গুলোর কয়েক জায়গায় নতুন করে আগুন জ্বলে উঠতে।

হাড়িয়া খালি থেকে স্পিড বোটে শাহপরির ঘাটে। সেখান থেকে চলে গেলাম আরও ভেতরে, একেবারে নাফের তীরে। সেখান থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার প্রশস্ত নাফ। তার ওপারেই রোহিঙ্গাদের দেশ। যা এখন আর তাদের নয়। মিয়ারমারের বর্বর সেনারা সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। নাফের তীরে দাঁড়াতেই যতদুর চোখ যায় মিয়ানমারের পাহাড়গুলো যেন সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজের সমারোহ। অথচ আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না, সেই সবুজের আড়ালে, পাহাড়ে ভাঁজে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী আর রাখাইনরা। পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলো জ্বলছে। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। কোনো জনমানুষের সেখানে থাকার সুযোগ নেই।

সীমান্তে স্থলমাইন পুঁতে রেখে বর্বরতার আরও চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার সময় যেন সেই মাইন বিস্ফোরণে উড়ে যায় তাদের দেহ। যারা বেঁচে আসবে এ পারে, তারা যেন আর ফিরে যাওয়ার সাহস না করে। ইতিমধ্যে মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু মানুষ। পা উড়ে গেছে কয়েকজনের। একদল অসহায় মানুষের সঙ্গে নিকৃষ্টতম এমন আচরণ দেখে পুরো বিশ্বই আজ স্তম্ভিত।

জীবন বাঁচানোর তাগিদে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আসছে বাংলাদেশে। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে এসব অসহায়ের পাশে দাঁড়াচ্ছে এ দেশের মানুষ। রোঙ্গিাদের বাংলাদেশে প্রবেশের মূল পথটাই হচ্ছে শাহপরির দ্বীপ। নৌকা বা ট্রলারে করে এসে তারা নামছে দ্বীপের জেটিতে। সেখান থেকে আসছে হাড়িয়াখালি। এরপর আশ্রয় মিলছে তাদের জন্য নির্মিত ক্যাম্পগুলোতে। চারটি খুঁটির ওপর একটি ত্রিপল বেঁধে মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।

শাহপরির দ্বীপে নামার পর প্রায় চার কিলোমিটার হেঁটেই আসতে হয়। এরপর খাল। এখানেও আরেক দফা নৌকা পারাপারের ঝামেলা। তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকা দিয়ে ১৫-২০ জনের এক একটি দল নৌকায় করে পাড়ি দিচ্ছে সেই খাল। হাড়িয়াখালি পৌঁছানোর পরই দিশেহারা রোহিঙ্গারা। কোথায় মিলবে একটু ঠাঁই, কে দেবে মুখে একমুঠো খাবার কিংবা একটু পানি? অসহায় মানুষগুলো শূন্য দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে চেয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে থাকে।

টেকনাফ এবং শাহপরির দ্বীপে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। রোহিঙ্গাদের জন্য স্রোতের মত সারা দেশ থেকে বাংলাদেশের মানুষ ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। মিয়ানমার সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে নাফ তীরে নামার পর থেকেই এখন তারা দেখছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ দেশের অসংখ্য মানুষ। যারা নাফের ওপারে নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন, তারা এপারে এসে দেখলেন আশ্রয় এবং মানবিকতা নিয়ে প্রস্তুত বাংলাদেশ। কেউ তাদের পারাপারের ব্যবস্থা করছেন। কেউ খাবার এবং পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ নিয়ে এসেছেন খাবার স্যালাইন। কেউ দিচ্ছেন নগদ টাকা। যাতে রোহিঙ্গারা এই টাকা দিয়ে পরবর্তীতে নিজেদের জীবন নির্বাহ করতে পারে।

আসিফ ইকবাল প্রিন্স নামে ঢাকার এক ব্যবসায়ী ব্যক্তিগত উদ্যেগে টাকা দিয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছিলেন। হাড়িয়াখালিতে বসা অস্থায়ী খাবারের দোকানের খাবার পণ্য যেমন ডিম, শশা কিংবা কলা- এসব কিনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। আবার হাড়িয়াখালি খালের তীরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে নৌকা দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছেন তিনি। কথা হতেই বললেন, ‘আরাকানের এসব অসহায় মানুষের ওপর নির্যাতন আর অমানবিকতা দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। দেখার জন্য ছুটে এলাম। তাদের সহযোগিতার জন্য সামান্য কিছু হলেও অবদান রাখার চেষ্টা করেছি। ওপারে না হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী বর্বরতা দেখাচ্ছে। এপারে আমরা তো মানবিক। মানুষের জন্য দয়া-মায়া আছে। সে কারণেই এখানে এলাম। মানবিকতা দিয়ে তাদের পাশে একটু হলেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।’