হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :
মোহাম্মদ নুরু (৩৫)। চলাচলে অক্ষম জন্ম দাতা পিতা আলী হোছন (৯৩) ও গর্ভধারিনী মা নুর বিবি (৭৭) কে কাঁধে নিয়ে এলাকার সবার সাথে এপারে চলে আসতে রওয়ানা দেন। সাথে তার স্ত্রী ও ৪ শিশু ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে ২ জন কোলের সন্তান। আর দুইজন কোনরকম হাঁটতে পারে। স্ত্রীও ৫ মাসের অন্তসত্বা। দু’য়েক গ্রাম হাঁটার পর রাতে রাজারবিল পাহাড়ি ঢালা পথে পৌঁছে। অতি কষ্টে মা-বাবাকে কাঁধে ভার করে ঢালার পথের মধ্যখানে মা-বাবাকে পৌঁছাতে পারলেও ক্লান্ত শরীর আর সহ্য করতে পারেনি নুরু। অপরদিকে প্রতিবেশীরাও তার জন্য অপেক্ষা করছেনা। পাহাড়ে একা হয়ে যাওয়ার ফলে ঢালা পথে একটি ত্রিপলের ছাউনি, কিছু খাদ্য ও দেড় লাখ কিয়াত দিয়ে নিঝুম পাহাড়ের অভ্যন্তরে ফেলে চলে আসেন বাংলাদেশে। শুধু নুরুর মা-বাবা নয়, একই এলাকার মৃত কালুর স্ত্রী, কাছিম আলীর পুত্র বাটুসহ বিভিন্ন এলাকার আরো ৬/৭ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখতে পায় শব্বির আহমদ। এই হৃদয় বিদারক ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে তিনিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

রাখাইনের পথে পথে মৃত্যু ভয়, আতংক :
মা-বাবা, সন্তানসহ পুরো পরিবার। পুরুষদের কাঁধে মুল্যবান মালপত্রের ভার। মহিলাদের কোমরে শিশু। কিশোরদের কাঁধে মাদুর কিংবা ত্রিপল। আবার অনেকের বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবারদের সাথে অনবরত পথ চলা। বর্মী সেনাদের নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও মৃত্যু থেকে প্রাণে বাঁচতে নিজ গ্রাম ছেড়ে কখনো পাহাড়, কখনো ধানবন, আবার কখনো গ্রাম্য পথ দিয়ে এগুতে থাকে। গন্তব্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ। পরিবারের সদস্য ইয়াছমিন আকতার (৪ মাস), জুবাইরা বেগম (৫), জাহেদা বেগম (২.৫), আবদুল হাফেজ (১০), রমজান আলী (১২), নুরুল ইসলাম (১৪), আবদুস সালাম (১৬), আবদুর রহিম (১৮), আবদুস শুক্কুর (২০) সুফিয়া খাতুন (৪২), হাবিবুর রহমান (২৮), সারা খাতুন (২৫) কে নিয়ে ১০ টি রাত ও দিন অতিবাহিত করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে শাহপরীরদ্বীপ সীমান্তে পা রাখে শব্বির আহমহদ (৪৬)। তিনি মিয়ানমার নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্ত থেকে পুরো পরিবারকে ২ লাখ ৯০ হাজার কিয়াত ও একটি নাকের দুল দিয়ে রাতে নাফনদ অতিক্রম করে শাহপরীরদ্বীপ সীমান্তে আসেন। তার সাথে কথা হলে উঠে আসে রাখাইনের হৃদয় বিদারক, মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক কাহিনী। যা শুনলেই শরীর শিউরে উঠে।
শব্বির আহমদ জানান, সে রাখাইনের রাছিডং থানার লামার পাড়ার বাসিন্দা। ২৫ আগস্ট পুলিশ ক্যাম্পে হামলার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠে রাখাইনের পরিস্থিতি। রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নেমে আসে আইয়ামে জাহিলিয়াতের মতো পৈশাচিক নির্যাতন। বর্মী পুলিশ ও সেনারা চারদিক থেকে মুসলিম অধূষ্যিত গ্রামগুলো ঘিরে চালায় নির্বিচারে গুলি। লাঞ্চার মেরে জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়ী ঘর। মেয়েদের নিয়ে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে। এসময় প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। অনেকে বাড়ীর ভিতর পুড়ে গিয়ে নির্মম মৃত্যূ হয়েছে। তবুও নিজ দেশ ও গ্রাম ছেড়ে এদেশে আসতে চাইনি শব্বিসহ অনেকে। কিন্তু তাদের পাশের সোহাব পাড়া গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে সেনারা। শব্বির বলেন, ওই পাড়ায় প্রায় ১৩ শতাধিক মানুষের বসবাস ছিল। এরমধ্যে ৩৪০ জনকে খুঁজে পেয়েছে। বাকিরা পুড়ে মারা গিয়েছে। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা রাছিডংয়ের আদ্দুইল্লা পাড়া, চান্দু পাড়া, নিলম্বা পাড়া, উপর পাড়া, আইডি ক্যাম্প গ্রামের প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা একসাথে ঈদের দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা করে। রাত ১২ টার সময় তারা রাখাইনের পূর্বাঞ্চল থেকে বড় পাহাড়ের রাজারবিল ঢালু পথ দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের দিকে এগুতে থাকেন। প্রায় ১৫ ঘন্টার পর সীতাপুরিক্ষা নামক গ্রামে পৌঁছে তাদের দল। সেখানে সেনাদের ঘাঁিট থাকায় পুরনায় গয়ামবারি নামক পাহাড়ের ঢালু পথ দিয়ে গেরাংঢং বা করাইতলী নামক স্থানে পৌঁছে চর এলাকায় অভুক্ত রাত কাটান। পরদিন সকাল হলে ক্লান্ত ও অভুক্ত শরীরে হাঁটতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। পথের গ্রাম গুলি যেন মৃত্যুপুরী ও ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। মাঠে মাঠে ধানের শীষ বাতাসে নুইয়ে পড়ছে। গরুগুলো তাদের মনিবদের হারিয়ে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। মাঝে মধ্যে সেনাদের টহল নজরে পড়লে যেন মৃত্যু দূত পৌঁছে গেছে। এসময় আল্লাহর জিকির ছাড়া আর কোন ঢাল তাদের ছিলনা। পথে পথে মৃত্যুর ভয়, আতংক, ঝুঁকি আর লাশের গন্ধ। এভাবে প্রতিমূহুর্ত আতংক ও মৃতুর ভয় নিয়ে হাঁটার পর অবশেষে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্তে পৌঁছে। সেখানে রয়েছে প্রায় আরো ৩০ থেকে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়ে রয়েছে। নাইক্ষ্যংদিয়াতে ৬ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় শাহপরীরদ্বীপে পৌঁছে শব্বিরের পরিবার।
শব্বির আহমদ আরও জানান, ওইপারে যারা রয়েছে তারা অত্যান্ত মানবেতর দিন যাপন করছে। খাওয়া নেই, পানি নেই, নেই সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মতো ঘাটের টাকা। পার্শ্ববর্তী একটি জনশূণ্য গ্রামে ৮ জন ব্যক্তি চাল আনতে গিয়ে সেনার হাতে আটক হয়েছে। এরমধ্যে শব্বিরের গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে হোছন আহমদ নামের একজন রয়েছে। অভুক্ত মানুষগুলো হাড্ডিসারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে নারী শিশু-দের অবস্থা আশংকাজনক। শব্বির মৃত্যু নগরী থেকে পুরো পরিবার নিয়ে এপারে আসতে পারায় সৃষ্টি কর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভুলেননি।

ছেলে পেয়ে মা বেহুঁশ :
মিয়ানমারের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে সীমান্ত শহর টেকনাফে পৌঁছে রোহিঙ্গারা। সেখানে বাস স্ট্যান্ডে অবস্থান করে চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। হাজারো রোহিঙ্গাদের ভিড়ে অবস্থান করে শব্বিরেরও পরিবার। এরমধ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর বিকালে টেকনাফ স্টেশনে শিশু ছেলে রমজান আলী (১২) ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়। প্রায় ঘন্টা খানেক খোঁজাখূঁিজর পর মিলে যায় ছেলে রমজানের। মা সুফিয়া খাতুন প্রাণের ধন রমজান আলীকে পেয়ে মুহুর্তেই বেঁহুশ পড়েন। এসময় মা-ছেলের এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। অনেক্ষণ চেষ্টার পর মা সুফিয়া খাতুনের হুঁশ ফিরলে ছেলেকে বুকে টেনে নেওয়ার দৃশ্য উপস্থিত সবার হৃদয় নাড়া দেয়। ##