রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমার সরকারকেই করতে হবে, মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের সবাইকে অবশ্যই ফেরত নিতে হবে। সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে, এই সমস্যার সমাধানও তাদের করতে হবে। এজন্য কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন হলে প্রতিবেশি দেশ হিসেবে আমরা তা করবো।’ সোমবার জাতীয় সংসদে আনীত একটি সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এখানে দীর্ঘদিন ধরে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে এবং এখন যারা আসছে তাদের সবাইকে ফেরত নিতে হবে। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে নিরাপত্তা, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সেফ জোন তৈরি করে দিতে হবে।’

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য সদস্যদের বক্তব্য শেষে দলীয় সংসদ সদস্য দীপু মনি আনীত এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়।

আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের ওপর জোর দাবি জানিয়ে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘আনান কমিশন তো তারাই গঠন করেছে, তারা কফি আনানকে তাদের দেশে আসতে দিয়েছে। কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। তাহলে তার সুপারিশটা তারা গ্রহণ করবে না কেন। আমরা রোহিঙ্গাদের যে আশ্রয় দিয়েছি এটা সাময়িক ব্যবস্থা। মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা কষ্ট করে আজ আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে কেউ যেন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা না করে। কেউ যেন আর্থিক সুযোগ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা না করে। সাহায্য নেই সহযোগিতা নেই- এক একখানা বড় বড় স্টেটমেন্ট দেবে সেটা আমরা চাই না। ১৬ কেটি মানুষকে আমরা খাবার দেই। তার সঙ্গে এরকম আরও ২, ৪, ৫ লাখ লোককে খাবার দেওয়ার মত শক্তি বাংলাদেশর রয়েছে। আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাব। এরপর কেউ সাহায্য দিতে চাইলে কমিটির মাধ্যমে দিতে হবে।’

আসন্ন জাতিসংঘ অধিবেশনে বিষয়টি তুলবেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জাতিসংঘ অধিবেশনে যাচ্ছি। সেখানে সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেবো। নিশ্চয়ই আমার বক্তব্যে মিয়ানমারের বিষয়টি তুলে ধরবো।’

নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গার সংখ্যা কেউ দুই লাখ বলবেন, কেউ ৫ লাখ বলবেন, কেউ ১০ লাখ বলবেন- যে যার মত বলতে থাকবেন, সেটা নয়- রোহিঙ্গা যারা ঢুকবে তাদের প্রত্যেকের ছবি তোলা, নাম-ঠিকানা লেখা তার সম্পূর্ণ হিসাব আমরা করতে শুরু করেছি। এর জন্য কোনও প্রকল্প নয়, আমি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল থেকে ইতোমধ্যে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। এটা করার জন্য যা যা খরচ লাগে তা দেওয়া শুরু করেছি। আমরা সাময়িকভাবে তাদের আশ্রয় দিচ্ছি। এক্ষেত্রে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে সেটা আমরা নেবো।’

দীপু মনির প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ লোক আজ এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে। একটি দেশের নাগরিকের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার- তার নিন্দা করার ভাষা পাচ্ছি না। একটি জাতির প্রতি মিয়ানমার সরকার এই আচরণ কেন করছে সত্যি বোধগম্য নয়। রোহিঙ্গারা তো মিয়ানমারেরই নাগরিক। সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরও ১৪৫টির মত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের অধিকার কেড়ে নিতে শুরু করে। ওই বছর থেকেই তাদের বিতাড়ন শুরু হয়।’

১৯৯১ সালে এক সমঝোতা স্মারকের ফলে মিয়ানমার আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই সমাঝোতার মাধ্যমে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তাদের নিজের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। সেখানে ২৫ হাজার রেজিস্ট্রার আর বেশি কিছু আন রেজিস্ট্রার রোহিঙ্গা থেকে গেল, তাদের আর ফেরত নেওয়া হলো না। আমি যতবার মিয়ানমার গেছি ততবার এদের ফেরত নেওয়ার কথা বলেছি। অন সাং সুচি আসার পর তাকেও ফেরত নিতে বললাম। কিন্তু ফেরত নেওয়া তো দূরের কথা আমরা দেখলাম ২০১২ সালে এক দফা আবার ২০১৫, ১৬ ও ১৭ সালে আবারও রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করলো।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই নির্যাতন এমন পর্যায় গেছে যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নৌকাডুবিতে নারী-শিশুর লাশ নাফ নদীতে ভাসছে। মাথা ও বুকে গুলি খাওয়া লাশ ভেসে আসছে। মেয়েদের অত্যাচার করা হচ্ছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা তো মানুষ, আমাদের ভেতর তো মনুষ্যত্ব আছে। আমরাও তো রিফুজি ছিলাম। রিফুজি হিসেবে থাকা কতটা কষ্টের তা আমরা বুঝি। আমরা মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আমরা চাই তারা তাদের দেশে ফিরে যাক। মিয়ানমার সরকারকে বলব- একটি দেশের নাগরিক অন্য দেশে রিফুজি হিসেবে থাকা মোটেও সম্মানজনক নয়।’

তিনি বলেন, ‘মুসলমানরা সব রিফুজি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে। আয়লানের লাশ দেখেছি সাগর পাড়ে, নাফনদীতে দেখি শিশুদের লাশ। কেন? সমস্ত মুসলিম উন্মাহ যদি এটা অনুভব করতে পারতো আর ঐক্যমত্য থাকতে পারতো, তাহলে মুসলমানদের ওপর এই অত্যাচারটা কেউ করতে পারতো না। আমি বার বার এটা বলেছি। আমি ওআইসি সেক্রেটারি জেনারেলকে বলেছি। বিভিন্ন মুসলিম দেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, এটা কোনও কথা নয়- আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি। মানবিক ভাবে তাদেরকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। এখানে বেশ কিছু হিন্দুও এসেছে।’

অন সাং সুচির ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে অনেকে অং সাং সুচির কথা বলেছেন। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন সামরিক জান্তা ক্ষমতায় ছিলো। মিয়ানমারে এখন কেবল গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু। সেখানে আইন করে অং সাং সু চিকে কিন্তু রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধান হতে দেওয়া হয়নি। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কাজেই তার ক্ষমতাটা কতটা, সেটা আপনাদের বিবেচনা করতে হবে। ওখানে সংসদেও কিন্তু মিলিটারি প্রতিনিধি বেশি।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। ধাপে ধাপে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিচ্ছে সে দেশের সরকার। এখন দেশ থেকে বিতাড়িত করছে। মানবিক কারণে তাদের জায়গা দিচ্ছি। কারণ আমরা তো অমানুষ হতে পারি না, অমানবিক হতে পারি না।’ এসময় রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যায়িত করা নিয়েও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।