মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

‘রোহিঙ্গা ইস্যু’ নিয়ে গত দু সপ্তাহ ধরে যা চলছে বা চালানো হচ্ছে তা টিনের চশমা পরিধানকারী ব্যক্তি  বা গোত্র ছাড়া সব মহলের কাছেই পরিস্কার। স্বৈরশাসন, নির্যাতন, বর্বরতা – সব প্রতিশব্দকেই হার মানিয়েছে রাখাইন রাজ্যের অরাজকতা। আর এই অরাজকতা কে কেন্দ্র করে বিবৃতি, প্রতিবাদ-মানববন্ধন, কোন কোন রাষ্ট্রের মানবতা’র পক্ষে থাকার আশ্বাস-অভিলাষ, জাতিসংঘের স্বাভাবিক হাডুডু ক্রীড়রত এবং রাষ্ট্র বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানগত স্যান্ডুইচ জটিলতা (ভারত-চীন) কে ছাপিয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের এক অঞ্চলের মানুষের মহান উদারতা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেই আহবান জানালেন- রোহিঙ্গাদের মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত, সেই থেকে কক্সবাজার জেলার ব্যক্তি-সমাজ-গোষ্ঠি দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে পাশে দাঁড়াচ্ছেন রোহিঙ্গাদের সংকটাপূর্ণ সময়ে।

ইতিমধ্যে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রবেশ করেছে কক্সবাজার এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। এই তিন লক্ষ শরনার্থীকে পরম মায়ায় কাছে টেনে নিয়েছে স্থানীয়রা।

‘রোহিঙ্গা’ দের রক্তাক্ত করা রাখাইন রাজ্যের রক্তস্বাদ গুলি কেনই বা নিপীড়কদের কাছে মধুময় হয়ে উঠছে? ইতিহাস, পুঁজিবাদ, ধর্মীয় তত্ব – কত কত ব্যখ্যা, উপাখ্যান এখানে!  তবে স্বৈর-শাসকের রক্তচক্ষু-জুলুমের আড়ালে পুঁজিবাদ থাকবেনা- তা কি করে হয়? সেই বৃটিশ দুঃশাসন, ইরাক-আফগান দখল, কোথায় ছিলনা – বানিজ্য অর্থনীতির এই রক্তপাতের রূপকথা।

কি-ই-বা আছে এই আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে ? শেষ আগস্টে শুরু হওয়া এই গণহত্যার বহুমাত্রিক কারণ থাকাটা অস্বাভাবিক নয় এবং এখানে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের ইন্ধন থাকাটা ও অপ্রত্যাশিত নয়।

তিনটি কারণ গুরুত্ব পাচ্ছে- প্রথমত, আরাকান রাজ্যে চীন বিশাল বিনিয়োগ করেছে।  খনিজ সমৃদ্ধ আরাকান হতে গ্যাসলাইন বিস্তৃত আছে চীনের বেইজিং পর্যন্ত। এই পাইপ লাইন দিয়ে খনিজ সরবরাহ মধ্য-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার হাইড্রোকার্বনের বিকল্প হতে পারে। এই রাজ্যের অস্থিরতা বানিজ্যে প্রভাব আনতে পারে এবং এই অস্থিরতার সুফল নিতে পারে আমেরিকার মত কোন পরাশক্তি।

দ্বিতীয়ত- দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ায় ইসলামিক নাম দিয়ে  সন্ত্রাসবাদকে প্রভাবিত করা এবং অস্ত্র বানিজ্যের রুপ উন্মোচন করা।

তৃতীয়ত- ASEAN এ মায়ানমারের সঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে কলহের বীজ বপন করা যার ফলে আশিয়ানের বন্ধনে ফাটল ধরবে এবং যার ফায়দা অন্য পরাক্রমশালীরা নিবে।

গুটিবাজদের চাল যাই হোক- নিপীড়নের স্বীকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের পর কক্সবাজারের ব্যক্তি, সমাজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, পাড়ার ক্লাব, রাজনৈতিক কর্মী সবাই- একমাত্র মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাছে থাকছেন। রান্না করা খাবার, শুকনো খাবার, কাপড়, মশারি, মাথা গুঁজার ত্রিপল – আরও কত সামগ্রী শরনার্থীদের পৌছুচ্ছে কক্সবাজারের মানুষেরা। ‘কক্সবাজারবাসী’ রোহিঙ্গা শরনার্থী বা অনুপ্রবেশকারীদের যেভাবে সাহায্য করছে ও উদারতা দেখাচ্ছে- বিশ্বের ইতিহাসে মানবিক বিপর্যয়ে কোন বিশেষ অঞ্চলবাসী এভাবে স্ব-উদ্যোগী হয়েছিল কিনা- গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। প্রতিদিন হাজার হাজার পিকআপ-ভ্যানে করে স্থানীয়রা তাদের সাহায্য সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত,শ্রমজীবি স্বেচ্ছাসেবক এ সাহায্যভিযানে নিজেদের নিবেশিত করেছেন।

আমরা আশা করি- রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধান হয়ত শীঘ্রই হবে। তারা তাদের জন্মভূমিতে হয়ত ফিরে যাবে স্বাধীনতা নিয়ে- কিন্তু তাদের জীবনের চরম সংকটাপূর্ণ মুহুর্তে যেভাবে স্থানীয় কক্সবাজার জেলার অধিবাসীরা পাশে থেকেছেন- তা ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দিবে। যদিও, আন্তর্জাতিক কোন গণমাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের এই কাছে থাকার স্বীকৃতি ওভাবে এখনো আসেনি

এখনো পর্যন্ত যত আন্তর্জাতিক পুরস্কার ব্যপক আলোচিত হয়, তন্মোধ্যে ‘নোবেল’ পুরস্কার তুলনামূলক কম প্রশ্নবিদ্ধ এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত। যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালে মায়ানমারের নেত্রী অং সান সূচি কে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল – তা ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিল অর্থবহ। কিন্তু গত ক’বছর ধরে সূচি’র প্রকৃত শান্তির-মুখোশ উন্মোচিত হলে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক রচিত হয়।  আং সান সূ চি-র নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেয়ার জন্য গত কিছুদিন ধরেই দাবি তুলেছেন কোটি বিশ্ববাসী।

তবে আং সান সূ চি-কে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির প্রধান বেরিট রেইস এন্ডারসন। তিনি বলেন  “১৯৯১ সালে আং সান সূ চি-কে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল মিয়ানমারে স্বাধীনতার জন্য সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কারণে। কিন্তু একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর কি করছেন, তা দেখা আমাদের এখতিয়ারে পড়ে না, একটা আমাদের কাজও নয়।”

ইতিহাসের নির্যাস হয়ত একদিন সাক্ষ্য দিবে- সুচি’র আপোশ ও মুখোশে’র লুকোচূরি । কাগুজে-কলমে সূচি’র নোবেল শান্তি পুরস্কার বাদ না হলেও বিশ্বের মানুষেরা সূচি কে শান্তির পেত্নী হিসেবেই মানছেন এখন।

১৯৩৮ সালে ন্যানসেন ইন্টারন্যাশনাল অফিস ফর রিফিউজিস নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করে চল্লিশ হাজার শরনার্থীকে পুনর্বাসিত করে। এ ছাড়া ও গত শতাব্দিতে রেডক্রস, অ্যামনেস্টি থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠান নোবেল শান্তি পেয়েছে। এখনো পর্যন্ত বিশ্বের কোন অঞ্চলের অধিবাসীরা শান্তিতে নোবেল জিতেনি। – তাতে কি!

এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাখাইন গণহত্যায় নিপীড়িত তিন লক্ষ রোহিঙ্গা কে পরম মায়ায় কাছে টেনে নিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারবাসী যে ঊদারতা, মানবতা দেখিয়েছেন- তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হওয়া দরকার।

নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত শান্তি পুরস্কারের মানদন্ড হিসেবে লিখা আছে “যিনি জাতিসমূহের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং বৃদ্ধি, যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত সেনাবাহিনীর অপসারণ বা হ্রাস এবং শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখবেন তাকে এই পুরস্কার দেয়া “। রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণে ‘যিনি’র ভূমিকায় লক্ষাধিক “কক্সবাজারবাসী” প্রত্যক্ষ অবদান রাখছে বৈকি।

রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সাময়িক শান্তি নিশ্চিত করছে বলেই “কক্সবাজারবাসী” নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখে। এই দাবি মোটেই অতিরঞ্জিত নয়, এ দাবি সময়ের প্রেক্ষাপটে খবই সাবলীল এবং অকপটে।

স্বীকৃতি পাক বা না পাক, ‘কক্সবাজারবাসী’ ইতিহাসে মানবতার প্রতীক হয়ে থাকবে।