-শাহ্‌ আলম

বর্তমান বিশ্বে সাড়ে ছয় কোটি গৃহছাড়া জনসংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, নিগৃহীত জাতি গোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গা। মায়ানমার এর আরকান প্রদেশে যাদের বাস বহুকাল ধরে। এদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৫-২০ লক্ষ। মায়ানমার এর সামরিক জান্তা সরকার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ত্ব আইন করে তাদের নাগরিকত্ত্ব অস্বীকার করে আসছে। তাদের আরকান ছাড়া করার উদ্দেশ্যে বিরতি দিয়ে তাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা আশ্রয় নিচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। বাংলাদেশ এর সাথে মায়ানমার এর স্থল ও জল সীমান্ত থাকায় তারা সহজেই এদেশে পার হয়ে আসতে পারে। রোহিঙ্গারা ধর্মে মুসলিম হওয়ায় তাদের প্রতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এদেশের নাগরিকদের বিশেষ সহানুভূতি কাজ করে। তাছাড়া তাদের দৈহিক গড়ন ও ভাষা স্থানীয় ‘চাটগাইয়া’ হওয়াই তারাও সহজে এদেশের পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়।

শরার্থী হিসেবে এদেশে তাদের প্রথম আসা ১৯৭৮ সালে। সদ্য স্বাধীন ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ সরকার নিজ দ্বায়িত্ত্ববোধ থেকে সেই থেকে জাতিসংঘের তত্বাবধানে তাদের শরনার্থী মর্যাদা দিয়ে এদেশে ক্যাম্প করে থাকার ব্যবস্থা করে। উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের লেদা এলাকায় দুটি ক্যাম্পে তাদের নিবন্ধিত সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এরপর থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের এদেশে আসার ঢল নামে। আরকান রাজ্যে তাদের উপর নির্যাতন না হওয়া সময় গুলোতেও তারা এদেশে আসার প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারন সীমান্ত এলাকায় তাদের শ্রমের চাহিদা ব্যাপক। এদেশীয় সীমান্তবাসী সস্তায় শ্রম পাবার আশায় তাদের আসাকে খারাপ চোখে দেখেনি। ফলে দিন দিন শ্রম দিতে আসা রোহিঙ্গারা এদেশে স্থায়িভাবে থাকার চিন্তাভাবনা করে। এতে তারা তাদের পরিবারের সদস্যদেরও আনা শুরু করে। সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারনে তাদের নিজ বসতবাড়িতে আশ্রয় দেয়াও শুরু করে। আস্তে আস্তে অনিবন্ধিত এ সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। এ বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এদেশে শরনার্থী হিসেবে থাকেনি। স্থানীয়ভাবে গ্রামে গঞ্জে ঢুকে পড়ে এদেশের সাধারন নাগরিকদের সমান সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তারা দিব্যি আছে।

স্থানীয়রা তাদের ফিরে যাবার কথা বললেই তারা আরকানে সামরিক জান্তাদের নির্যাতন, নিপীড়নের দোহাই দিয়ে ফিরে যায়না। তারা অং সান সুচি কে তাদের পরিত্রানকারী হিসেবে দেখতো। এদেশের কিছু দালাল এর মাধ্যমে তাদের বেশিরভাগই এদেশীয় নাগরিকত্ব সনদ সংগ্রহ করে। বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে গমন করে। স্থানীয়ভাবে জমি কিনে, বনভুমির দখল কিনে স্থায়ী হয়ে যায়। আবার স্থানীয়দের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ব হয়ে অনেকেই এদেশে স্থায়ী হওয়ার ব্যবস্থা করে।

এভাবে রোহিঙ্গারা তাদের আরকানে নির্যাতন, নিপীড়নের প্রতিবাদের স্প্রীহা ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা ভুলেই যায়। সুখে থাকতে কে ঝামেলাই যাবে। ফলে আরকানে তাদের শক্তিশালী অবস্থান আরো দুর্বল হয়ে যায়। জাতিগত নির্যাতন হলেই তারা প্রতিরোধের বদলে অপেক্ষাকৃত সহজ পথ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

চলমান দমন নিপীড়নে আরো প্রায় ৩ লাখ নতুন করে এদেশে পালিয়ে আসলো। সবমিলিয়ে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলদেশের ঘাড়ে। এর প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে অবস্থান করছে। যেখানে উখিয়া-টেকনাফের জনসংখ্যাই প্রায় ৫ লাখ। বর্তমানে যে সংকট চলছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে, উখিয়া-টেকনাফে বাংলাদেশীর সংখ্যা লঘুতে পরিণত করবে। স্থানীয় জনসংখ্যার থেকে শরনার্থীর সংখ্যা বেশি হলে, কি পরিনতি হতে পারে তা সাধারনভাবেই অনুমেয়।

অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ব্যবস্থা এদেশীয় আইনমতে নাই। সুতরাং হু হু করে বাড়তে থাকা রোহিঙ্গাদের সন্তানরা বড় হচ্ছে এদেশের সন্তানদের সাথে, একইসাথে খেলাধুলা করছে, অনাকাংখিত আচরনে অভ্যস্ত হচ্ছে ফলে সামাজিকীকরন প্রক্রিয়ায় আমাদের সন্তানদের মধ্যে বিশাল ঘাটতি থেকে যাচ্ছে যা কোনভাবেই পূরনীয় নয়। বলতে গেলে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অজান্তেই ফাঁকি দিচ্ছি, যা একদিন আমাদের ভোগ করতে হবে।

সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফের বাসিন্দা হওয়ার কারনে এমনিতেই এই এলাকার লোকজনের অপরিসীম নাজেহালের শিকার হতে হয়। উখিয়া-টেকনাফ থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী বাসগুলোতে চেকিং এর নামে যে হারে নাজেহালের শিকার হতে হয় তা ভুক্তভোগীরা জানে।

ঢাকায় বসবাসকারী কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের ঢাকার পার্সপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করা বন্ধ। তাদেরকে কক্সবাজার জেলার অফিসে গিয়েই অতিরিক্ত ফর্ম পুরণ করে পাসপোর্ট করতে হয়। অন্যান্য জেলায় কি এরকম করতে হয়? এর কারন এই রোহিঙ্গা সমস্যা।

২। চলমান রোহিঙ্গাঢলে প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত অনেক ঘটনা ঘটছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মানবিক সহায়তা ও সুযোগ সন্ধানীদের অমানবিকতা। একদল মানুষ অসহায় মানুষদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা যোগাচ্ছে। আরেকদল পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়ে আসা গৃহপালিত গরু, ছাগল, মুরগী নামমাত্র মূল্যে কিনে পবিত্র কুরবানের ঈদ উদযাপন করেছে। পালিয়ে আসা নারীদের ধর্ষনের ঘটনাও ঘটেছে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যাচ্ছে।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা ইচ্ছেমতো সংরক্ষিত বনভুমির গাছ নিধন করে, পাহাড় কেটে বাসস্থান তৈরি করছে। স্থানীয় কিছু অসাধু উচ্চমূল্যে গৃহস্থালীর নির্মান সামগ্রী বিক্রি করছে। মাথাপিছু ৫০০-১০০০ টাকার বিনিময়ে নৌকায় করে সীমান্তে রোহিঙ্গা পার করানো হচ্ছে।

শুধু সীমান্তবর্তী এলাকায় তারা স্থির থাকছেনা, শহরমুখী হওয়াও শুরু করেছে। অপেক্ষাকৃত স্বাবলম্বী রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরে ভাড়া বাসায় উঠছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

৩। আমাদের কি করণীয়?

ক।মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাচার জন্য আমরা সাময়িকভাবে তাদের মানবিক সহায়তা দিতে পারি। তবে তা এলোমেলোভাবে না দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় পরিচালনা সংস্থার মাধ্যমে দেওয়া যায়।এতে করে সবাই পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তা স্থানীয় প্রশাসন করতে পারে কারন তারা আইনী কতৃত্বপ্রাপ্ত।

খ। সরকারী তরফ থেকে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করা।

গ। তাদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কে অনর্ভুক্ত করা।

ঘ। রোহিঙ্গারা যাতে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে ছড়িয়ে যেতে না পারে তা পর্যবেক্ষনে রাখা।

ঙ। স্থানীয় বিবাহ ও নাগরিকত্ত্ব সনদ যাতে না পেতে পারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ এগুলোর দালালী করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা।

চ। স্থানীয়ভাবে গ্রামে-গঞ্জে বসবাস শুরু করা পুরনো রোহিঙ্গাদেরও অস্থায়ী ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য স্থানীয় বাংলাদেশীদের ভুমিকা অগ্রগণ্য। যা খুবই দরকারী।

ছ। অনিবন্ধিত সকল নতুন, পুরনো রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডাটাবেজ তৈরি করা জরুরী। যাতে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে।

জ। স্থানীয় আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে পুলিশের অতিরিক্ত বিশেষ দল মোতায়েন করা।

ঝ। এ বিপুল রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে জনমত গঠনে সকল বাংলাদেশীদের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ন।

ঞ। সরকারীভাবে ওআইসি’র সকল সদস্য রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে অবহিত করা ও ওআইসি’র বিশেষ সভা আহবানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

প। সামনে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ত্ব ফিরিয়ে দেয়া ও বাংলাদেশ থেকে সকল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মায়ানমারকে চাপ দিতে সকল সদস্য রাষ্ট্র ও অন্যান্য আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা কে ব্যবহারের উপর জোর দেয়া।

এই আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে সবথেকে বেশি ভালবাসা দাবিদার। এখানকার আলো, বাতাস, ভাত খেয়ে আমরা বেঁচে আছি। কোন দূরদেশের ফার্স্টলেডি এসে মায়াকান্না দেখালো, আর আমরা অমনিই নিজ দেশের, মানুষের ভুমিকাকে বেমালূম ভুলে, রোহিঙ্গাদের প্রতি আমার দেশের মানবিকতার উপর সেই দেশের মানবিকতাকে স্থান দিয়ে সেই দেশের মহত্ত্বের গান গাইবো, তা তো দেশপ্রেমের চিহ্ন না। মনে রাখা উচিৎ, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ, সুতরাং ঈমান’র একটা অঙ্গ অপূর্ণ রাখা মুমিনের দ্বায়িত্ব নয়।

সেই দেশের ৬ গুন ছোট আয়তন, দ্বিগুন জনসংখ্যা, ১৮ গুন কম মাথাপিছু আয়ের দেশ বাংলাদেশ গত ৪০ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের লালন পালন করে আসছে।

সুতরাং রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের থেকে বড় মানবিক কোন দেশ নাই এই গর্বে গর্বিত হয়ে আসুন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রতিবাদ ও তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেবার জন্য যার যার জায়গা থেকে কাজ করি।

-লেখক, গ্রাজুয়েট গবেষণা  সহকারি, ইউনিভার্সিটি অব  সাউর্দান মিসিসিপি, যুক্তরাষ্ট্র।

 ইমেইল: shahalam149@gmail.com