সংবাদ বিজ্ঞপ্তি:
সার্কভূক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ‘সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন’ বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের নেতারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গাদের দূর্দশা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলা ও পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় স্থাপিত রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প পরিদর্শনে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখার কেন্দ্রীয় মহাসচিব অধ্যাপক মাওলানা আবেদ আলী।

অধ্যাপক মাওলানা আবেদ আলীর নেতৃত্বে একটি পর্যবেক্ষক দল বুধবার ও বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্যে ১০টি প্রস্তাবণাও উত্থাপন করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা পরিদর্শন শেষে তাৎক্ষনিক এক প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক মাওলানা আবেদ আলী এই সব প্রস্তাবণা তুলে ধরেন। ১০টি প্রস্তাবণার প্রধান ও অতিগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গার প্রিন্টযুক্ত ডাটাবেস তৈরির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

মানবাধিকার নেতা আবেদ আলী মনে করেন, মিয়ানমার থেকে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার ফিঙ্গার প্রিন্টযুক্ত ডাটাবেস তৈরি করা না গেলে তারা বাংলাদেশের জনবসতিতে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তখন তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতে কক্সবাজার জেলা তথা বাংলাদেশে সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি এবং দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।

তিনি বৃহস্পতিবার দুপুরে উখিয়ায় সাংবাদিকদের কাছে ওই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ওই সময় সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের কক্সবাজার জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী, জেলা সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার সাঈদ ও উখিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি কবি ও রাজনীতিক আদিল উদ্দিন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অস্থায়ী ক্যাম্প পরিদর্শনের পর মাওলানা আবেদ আলী মনে করেন, রোহিঙ্গা জাতি গোষ্টীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হওয়া মিয়ানমার সরকারের শতাব্দির জঘন্যতম এই নির্যাতন, নিপীড়ন, বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

তাঁর মতে, একদিকে মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন নিপীড়নে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর শিশুরা একটু আশ্রয়ের আশায় ‘মৃত্যু সীমান্ত’ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা এই সকল রোহিঙ্গারা এই দেশের (বাংলাদেশ) চেনা-অচেনা কিছু দুর্বৃত্তের হাতে লুট, নির্যাতন ও নারীরা অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। নির্যাতিত রোহিঙ্গারা যেন এখন উভয় সংকটে পড়েছেন। রোহিঙ্গা জাতিটি একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসিদের বর্বরতম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেও নিপীড়ন ও প্রতারণা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র, দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যম ও স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ইমেজ থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে, আরাকান রাজ্য বিলুপ্ত করে রাখাইন রাজ্য ঘোষণা করা আরকানের প্রতিটি অঞ্চলে নির্বিচারে বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়ার পাশাপাশি গণহারে রোহিঙ্গা তরুণ ও শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। এখনও এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেই চলেছে।’

সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন মনে করছে, এই পরিস্থিতিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু সীমান্ত পার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ও আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। আমাদের নেয়া তথ্য মতে, এই ক’দিনে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ দাবি করছে, আরও অন্তত দেড়লাখ রোহিঙ্গা সীমান্তের পথে রয়েছে।

এই সকল নির্যাতিত নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্টীকে বাংলাদেশে মানবিক বিবেচনায় আশ্রয়ের সুযোগ করে দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন ও মানবতাবাদী সব সংগঠনের পক্ষ থেকে অকৃত্রিম ও অসীম কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

তিনি আশা করেন, প্রধানমন্ত্রী নিপীড়িত এই জাতিকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি তাদের সংকট সমাধানে উদ্যোগী হয়ে চুড়ান্ত সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

মাওলানা আবেদ আলী পর্যবেক্ষক দলের পাওয়া বিভিন্ন তথ্যও সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। তাদের মতে, ওপার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে পর্যবেক্ষক দলটি নিশ্চিত হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে কতিপয় দুস্কৃতিকারি যুবকদের লালসা ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন। এই সকল রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা গবাদি পশু নিয়ে এসেছেন তাদের অধিকাংশেরই পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে নয়তো ‘কিনে নেয়ার নাটক সাজিয়ে’ অত্যন্ত অল্পদাম ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। একই সাথে নারী শ্লীলতাহানির পাশাপাশি তরুণীদের রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। গণধর্ষণের শিকার হওয়া এমন রোহিঙ্গা নারী চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন থাকার খবরও আমরা জানতে পেরেছি।

রোহিঙ্গাদের জন্য স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো ঘুরে সেখানে খাবারের জন্য, পানির জন্য আর ওষুধের জন্য হাহাকার চলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়, তাদের নিরাপত্তা দেয়া, প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ ও রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশি সমাজে মিশে যেতে না পারে তার জন্য সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবণা তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রস্তাবণা গুলো হলো, (১) শুরুতেই মানবিক সহায়তার পাশাপাশি দ্রুততর সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের এমন একটি ডাটাবেসের অধীনে নিয়ে আসতে হবে যাতে চাহিবা মাত্রই তাদের চিহ্নিত করা যায়। এমন একটি প্রস্তাবণা হলো, রোহিঙ্গাদের আঙ্গুলের চাপযুক্ত (ফিঙ্গার প্রিন্ট) ‘রোহিঙ্গা ডাটাবেস’ তৈরি। এটি করা গেলে রোহিঙ্গারা কখনোই বাংলাদেশিদের সাথে মিশে যেতে পারবে না। (২) রোহিঙ্গাদের শুধু মানবিক সহায়তা দিয়ে বছরের পর বছর বাংলাদেশে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার পক্ষে আমরা নই। আমরা মনে করি, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিথযশা সাবেক কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে একটি আলাদা কমিটি গঠন করে মিয়ানমার ও বিশ্ব দরবারে উন্নত লবি’র মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। (৩) যে সকল বাংলাদেশি দুস্কৃতিকারি নির্যাতিত হয়ে এই দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সম্পদ লুট, প্রতারণা, নারীদের অপহরণ ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। (৪) মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। (৫) রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে বহিস্কার ও তাদের কার্যক্রম সীমিত করতে হবে। (৬) রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (৭) বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারি রোহিঙ্গারা যাতে কোন ধরণের অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে এবং অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন দল ও এনজিও সংগঠনের প্রতি প্রশাসনের কড়া নজরদারি রাখতে হবে। (৮) রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মিয়ানমার সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে প্রতিকার ও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আল্টিমেটাম দিতে হবে। (৯) বাংলাদেশে বসবাসরত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ সকল সংখ্যালঘুদের উপর যে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেই বিষয়ে ধর্মীয় আলেম-ওলামাসহ সমাজের সচেতন নাগরিকদের সজাগ থাকতে হবে ও (১০) সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের একটি পর্যবেক্ষণ টিম আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শনের অনুমতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।

সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষক করেন, কেন্দ্রীয কমিটির মহাসচিব ও কক্সবাজার জেলা কামিটির সাধারন সম্পাদক সারওয়ার সাঈদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।