পূর্বপশ্চিমবিডি:

রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ধর্ষণ, গণহত্যা, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের ঘটনায় রাখাইনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক কোনো মহলেরই তোয়াক্কা করছে না মিয়ানমার সরকার। সেখানে সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে গত দুই সপ্তাহে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা এবং ১০ হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে আহত ও অনাহারে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা। এখনো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বিজিবির প্রতিরোধের মুখে সীমান্তে অপেক্ষা করছে বলে নিশ্চিত করেছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো।

এদিকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও চলমান সেনা অভিযানের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার দুপুরে ঢাকায় দেশটির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তার হাতে একটি প্রতিবাদপত্র ধরিয়ে দেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উইংয়ের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহে ৪ বার তলব করা হলো সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে। পাশাপাশি অব্যাহত নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত নেয়ার দাবি জানানো হয় বলে মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

এতে বলা হয়, নিরস্ত্র নারী ও শিশু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনায় উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। অভিযানে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ করায় ব্যাপক হারে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ভীত-সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গারা নজিরবিহীন সংখ্যায় বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বাংলাদেশ এই সহিংসতার শিকার হতে পারে না। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার দাবিও জানিয়েছে বাংলাদেশ।

প্রতিবাদপত্রে ওই রাজ্যে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থার অবাধ প্রবেশাধিকারও চাওয়া হয়।

ওদিকে সীমান্তে মিয়ানমারের স্থলমাইন পুঁতে রাখার সত্যতা পাওয়ায় বুধবার মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতের কাছে দেয়া পত্রে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশসংলগ্ন সীমান্তে মিয়ানমার ভূমিমাইন পুঁতে রাখছে বলে অভিযোগ পাওয়ার পরপরই বুধবারই বিষয়টি নিশ্চিত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ সরকার সংশ্লিষ্ট দু’টি সূত্রের বরাত দিয়ে বুধবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দিতেই এই মাইন পুঁতেছে মিয়ানমার। সীমান্ত পরিস্থিতির সঙ্গে ওই দুই সূত্রের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে মাইন স্থাপনের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

মিয়ানমারের যে গ্রুপগুলো ভূমিমাইন পুঁতে রেখেছিল তাদের গায়ে কোনো ইউনিফর্ম ছিল না। একটি সূত্র বলেছে, মিয়ানমার নিজেদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার কাছ ঘেঁষে ভূমিমাইন বসাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও কাঁটাতারের বেড়ার কাছ ঘেঁষে তিন থেকে চারটি গ্রুপকে স্থলমাইনের কাজ করতে দেখেছে। তারা মাটিতে কিছু একটা পুঁতে রাখছিল। পরে গোপন সংবাদদাতারা নিশ্চিত করে মিয়ানমার ভূমিমাইন পুঁতে রেখেছে।

সীমান্তে মিয়ানমারের পুঁতে রাখা মাইনে বাংলাদেশে পলায়নরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হতাহত হওয়ার কিছু কিছু খবরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এসেছে। মঙ্গলবার মিয়ানমার সীমান্তে দু’টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়া গেছে। সোমবার থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী ভূমিমাইন পুঁতে রেখেছে। মঙ্গলবার সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় এক কিশোরের পা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। আরেক কিশোর আহত হয়েছে। পা হারানো ওই কিশোরকে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আনা হয়েছে।

যে স্থানটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে সেখানে সোমবার এক রোহিঙ্গা শরণার্থী গিয়েছিলেন। সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ড এলাকা থেকে তিনি যে ছবি তুলেছেন তাতে দেখা গেছে কাদার ভেতরে ১০ সেন্টিমিটারের গোলাকার ইস্পাতের একটি চাকতি পুঁতে রাখা হয়েছে। তার বিশ্বাস সেখানে এ ধরণের আরো চাকতি পুঁতে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা দেখতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার সফর করবেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোগান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট ক্যাভুফোগলু। এ সফরে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলিও থাকবেন। এ জন্য গতরাতেই বিশেষ ফ্লাইটে তারা ঢাকা পৌঁছেছেন।