ডেস্ক নিউজ:
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টমত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা থাকবে কী থাকবে না, সেই বিতর্কের সুরাহা না হতেই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আরও কিছু ধারা। নতুন এই আইনে ৫৭ ধারা রহিত করার কথা বলা আছে। তবে ওই ধারার আদলেই নতুন আইনে থাকছে ১৯ ধারা। থাকছে বিদেশে অবস্থানকারীদেরও বিচারের আওতায় আনার বিধান। আইনজীবীরা বলছেন, এই আইন সাইবার সিকিউরিটির জন্য যতটা না, তার চেয়ে কঠোর হবে ডিজিটাল মাধ্যমে কোনোকিছু প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যবিকৃতির বিষয়টি যথাযথভাবে স্পষ্ট না করলে এই আইনের অপব্যবহারের সুযোগ ৫৭ ধারার থেকে বেশি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। তবে এ ধরনের আইনের প্রয়োজনও আছে মনে করছেন প্রযুক্তিবিদ ও বিশ্লেষকরা। আর আইনমন্ত্রী বলছেন, এ আইন নিয়ে কোনও মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি।

৫৭ ধারার বিকল্প কি ১৯ ধারা?

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে—‘কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে তাহার এই কাজ একটি অপরাধ হবে।’ এর শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা।

আইসিটি আইন প্রবর্তনের পর থেকেই সমালোচনার মুখে পড়ে এই ৫৭ ধারা। এই ধারায় উল্লেখ করা বিষয়গুলোর স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন না থাকায় এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থেকেই ধারাটি বাতিল করার দাবি ওঠে। নতুন করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরির বিষয়টি সামনে এলে জানানো হয়, ওই আইনটি এলে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা রহিত করা হবে। তবে নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে থাকছে ১৯ ধারা, যেটা ৫৭ ধারার আদলেই আরও নিখুঁতভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে কার্যত আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা ‘রহিত’ করে ১৯ ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধারায় অপরাধ জামিনযোগ্য এবং সর্বোচ্চ সাজা ২ বছর করা হলেও এতে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, মালামাল জব্দ ও গ্রেফতার সংক্রান্ত আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার বিধান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এই আইনের খসড়া তৈরির কাজে যুক্ত প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার মনে করেন, আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারাটি মূলত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ১৯ ধারা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। তবে ৫৭ ধারার যে বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, নতুন আইনে সেই বিতর্কগুলো থাকবে না।

আরও যা থাকবে নতুন আইনে

খসড়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ১৫(৫) ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি নাগরিক যদি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিষয় বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অবমাননাকর মন্তব্য, প্রচার বা অপপ্রচারে লিপ্ত হয় বা সেটাতে মদদ দেয়; তাহলে ওই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি নাগরিক ডিজিটাল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটনের অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য শাস্তি তিন বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

এই আইনে অপরাধীদের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধারায় বিদেশে বসে অপরাধ সংঘটনকারীদেরও বিচারের আওতায় আনার বিধান রয়েছে। ডিজিটাল ও সাইবার সিকিউরিটি লঙ্ঘনের দণ্ডের বিষয়ে আইনের ধারা-১৬তে বলা আছে, যদি কোনও ব্যক্তি বা বিদেশি নাগরিক ধারা ১৫-এর উপ-ধারা ১(ক) ও ১(খ)-এর অধীন কোনও অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ (চৌদ্দ) বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ২ (দুই) বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারায় বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনও অংশের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা আছে।

গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয় উল্লেখ করে আইনে ধারা-১৭ তে বলা আছে, অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনও ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া কেউ তার ব্যক্তিগত ছবি তুললে ও প্রকাশ করলে বা কাউকে পাঠালে বা বিকৃত করলে বা ধারণ করলে তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে অপরাধ হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে ৫৭ ধারাটি একেবারেই সঙ্গতিহীন বলে মনে করেন প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইনটি করা হয়েছিল ডিজিটাল স্বাক্ষর ও ইলেকট্রনিক সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিষয়ের জন্য। সেটি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে নতুন যে আইন হতে যাচ্ছে, সেখানে এই সমস্যাগুলো থাকবে না। তথ্যপ্রযুক্তির যে যুগে আমরা পা দিয়েছি সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এধরনের আইন জরুরি। তবে ক্ষতিকর যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখাও জরুরি।’

যদিও ব্যরিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ফলে জনমনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় ভীতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কার্যকর করে ৫৭ ধারাকে বাতিল করার বিষয়টিকে ‘উপহাস’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা অন্যায়ভাবে এই ধারার কারণে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি এটা ভীষণ অন্যায়। কেননা, এই ধারার বিভিন্ন বিষয় যদি নতুন আইনে প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে এই ধারা বাতিল করা নিয়ে বাগাড়ম্বর বাতুলতামাত্র। নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে যদি একই বিষয় থাকে, তাহলে নিপীড়নের ধরন পাল্টাবে, কিন্তু আইনের নামে নিপীড়ন বন্ধ হবে না। এই ধারা কেবল নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করছে তা-ই নয়, এর ফলে ব্যক্তির মুক্ত জীবনযাপন করার মৌলিক অধিকারও খর্ব হচ্ছে।’

ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম মনে করেন, ৫৭ ধারার মতো ধারা থাকা উচিত না। কারণ এতে অপব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ থাকে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যেন এধরনের কোনও ধারার সংযোজন না হয়, সে কথা উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও আইন তৈরি করার সময় এটা ধরেই নেওয়া হয় যে এর অপপ্রয়োগ হবে না। কিন্তু সুযোগ থাকলে তার অপব্যবহার হয়নি— এই উদাহরণ নেই বললেই চলে। যে আইন অপব্যবহার করা যায়, সে আইন থাকা বা না থাকা সমান। আমরা যদি আইন প্রয়োগে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করতে পারতাম, তাহলেই আর এই সমস্যাগুলো হতো না।’

এদিকে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কার্যকর হলে বেশকিছু জটিলতার নিরসন হবে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘এই আইন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। নতুন এই আইন নিয়ে যারা কথা বলছেন, তাদের সবাই সঠিক কথা বলছেন না।’