তপন মাহমুদ

তপন মাহমুদগত কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একটা বিষয় নিয়ে দেশের মানুষের সংশয় খেয়াল করছি। তারা কি রোহিঙ্গাদের পক্ষে বলবে নাকি বিপক্ষে? নাকি চুপচাপ থাকবে? অথবা ঠিক কী ভাষায় প্রতিবাদ জানাবে, সেটা নিয়েও মনে হয় দোটনায় আছেন অনেকে।
তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত যে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের ওপর নির্যাতন করছে। তাদের হত্যা করছে। তাদের দেশছাড়া করছে। সবাই এটা মানছেন যে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া দরকার। কিন্তু আমরা এও জানি আমাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের কণ্ঠ নাফ নদী পেরিয়ে মিয়ানমার সরকারের কান পর্যন্ত খুব একটা পৌঁছাবে বলে মনে হয় না। কেবল আন্তর্জাতিক শক্তির হস্তক্ষেপই এটা থামতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য সংকট বহুমুখী। কারণ এই নির্যাতিত রোহিঙ্গা আর রাখাইনরা সীমান্ত পেরিয়ে এখানেই আশ্রয় খুঁজছে। আগেও এমনটি বারবার ঘটেছে। আর তাতে একটু একটু করে নাফ নদী পেরিয়ে আসা রোহিঙ্গা আর রাখাইন শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় লাখ ছুঁয়েছে। আমাদের মতো জনবহুল একটা রাষ্ট্রের কাছে সত্যিই তা বিরাট বোঝা। অপরদিকে তাদের ঠাঁই না দেওয়া বড় ধরনের অমানবিকতা।

তাহলে কী করবো আমরা? কী করতে পারে আমাদের সরকার? মিয়ানমারের জান্তা সমর্থিত সুচি সরকারের সাথে কী ভাষায় কূটনীতি করবে বাংলাদেশ? আমার মনে হয়, আমাদেরকে প্রথমেই কয়েকটা বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান নিতে হবে।

১. মিয়ানমার সরকার দাবি করে আসছে রোহিঙ্গারা জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গেও যুক্ত। আর এ অজুহাতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু তাদের এ ধরনের গড়পড়তা যুক্তি আসলে কতটা যৌক্তিক? গোটা একটা জাতি বা গোষ্ঠী কি মুহূর্তেই জঙ্গি হয়ে উঠতে পারে? নাকি রোহিঙ্গা আর রাখাইনদের কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চাইছে না বলেই এই জঙ্গি তকমা। আর এর মাধ্যমে খুব সহজেই আন্তর্জাতিক শক্তির চোখে ধোয়া দিতে পারছে শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচি সরকার।

২. রাষ্ট্রীয় নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ২০১৩ সালেই মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে গঠন করা হয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। তারা এরই মধ্যে কিছু সহিংস সংঘবদ্ধ হামলা চালিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। এখন মিয়ানমার সরকার তাদের এ কার্যক্রমকে জঙ্গি কার্যক্রম বলে আখ্যায়িত করছে। এমনকি তারা আরসাকে ‘বাঙালি সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছে। তবে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বলছে, তারা জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র সংগঠন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, তাদের লড়াই ধর্মীয় নয়, বরং জাতীয়তাবাদী। নিজেদেরকে জাতিগত মুক্তিকামী হিসেবে উল্লেখ করে তারা বলছে, আরসা ততোদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মায়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মেনে নেওয়া না হবে। আরাসা কিন্তু পরিষ্কারভাবেই বলছে তারা বিষয়টার রাজনৈতিক সমাধান চায়।

তাই বাংলাদেশেন জনগণের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে এই বার্তাই পাঠাতে হবে যে, সুচি সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা রোহিঙ্গা আর রাখাইনদের জাতিগত স্বীকৃতি দিয়ে সমস্যার সমাধান করবে নাকি তাদের চরমপন্থার পথে ঠেলে দেবে? আমাদের পরিষ্কার অবস্থান হওয়া উচিত, রোহিঙ্গা ও রাখাইনরা কোনও ধরনের জঙ্গি তৎপরাতা চালালে, তার দায় একান্তই তাদের। কিন্তু তাদের জাতিগত লড়াইয়ের প্রতি (যতদিন না তাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ না হয়) আমাদের নৈতিক সমর্থন থাকবে।

৩. বাংলাদেশ যেহেতু একটা জাতিরাষ্ট্র, সেহেতু পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে, যেকোনও ধরনের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, তার তীব্র বিরোধিতা করা এবং নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এছাড়া একটা জাতি কোনও অবস্থায় গেলে শরণার্থী হয়ে অন্য একটা দেশে ছুটে যায় তা আমাদের চেয়ে আর কে ভালো বুঝবে? তাই মিয়ানমার সরকারের প্রতি আমাদের চাপ বাড়াতে হবে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের কাছে শুধু রাজনৈতিক নয় বরং অনেক বেশি হৃদয়ের।

৪. কারণ হিসেবে মিয়ানমার যাই বলুক না কেন, রোহিঙ্গা ও রাখাইনরা দলে দলে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকেই ছুটে আসছে। নাফ নদীতে ভাসছে মানবতা। গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরছে নাম না জানা কোন এক রোহিঙ্গা বা রাখইন শিশুর ভাসমান নিথর শরীর। ওর মৃত্যু তবু অপরাধী করছে না মিয়ানমার সরকারকে। কিন্তু আমাদের মন কাঁদছে। আমাদের ক্ষিপ্ত করছে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার যাই বলুক না কেন, বা যতই চুপ থাকুন না কেন, শরণার্থীদের ঠাঁই কিন্তু দিচ্ছে। এটাই আমাদের হৃদয়ের দিক। কিন্তু এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। তাই বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গা ও রাখানইনদের ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরতে হবে। এজন্য যত ধরনের কূটনীতি করতে হয় করা দরকার।

৫. একটা খবর কিছু গণমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে যে, মিয়ানমার সীমন্তে ইসলামিক জঙ্গি এবং আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। আমার কাছে মনে হয়, মিয়ানমারকে কোনও ধরনের চাপে না রেখে তাদের এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়ার আগে আরও গভীরভাবে ভাবার দরকার ছিল। এটা সমস্যাকে কোনোভাবেই সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে না। ‘মিয়ানমার সরকারের জঙ্গি ফাঁদে’ বাংলাদেশ কেন পা দিচ্ছে আমার বুঝে কুলাচ্ছে না।

হ্যাঁ এটা সত্যি যে, সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা যেভাবে রোহিঙ্গা বা রাখাইনদের জাতিগত জায়গা থেকে সমর্থন করতে পারি, একটা রাষ্ট্রের জন্য তা খুব সহজ নয়। অনেক বৈশ্বিক, আঞ্চলিক সমীকরণ মিলিয়ে তাকে চলতে হয় বটে। কিন্তু অবশ্যই সরকারের আরও শক্ত ও স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত। না হলে বিষয়টা ঝুলে থাকলে, আমাদেরই বিপদ।

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ