বাংলা চলচ্চিত্রের ভুবনে যে কয়জন ক্ষণজন্মা শিল্পী এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নায়ক সালমান শাহ। যিনি তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রার শুরুর দিন থেকেই জয় করে নিয়েছিলেন অসংখ্য ভক্তের হৃদয়। কিন্তু কালের নির্মম পরিহাসে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এই ‘স্টাইল আইকনের’ জীবন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায়ই নিভে গেছে তাঁর জীবনের সব আলো।

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬। হঠাৎ করেই এক গভীর কালো মেঘ উড়ে আসে বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে। নায়ক সালমান শাহ আর নেই। খবরটা শোনামাত্র যেন থমকে যায় পুরো চলচ্চিত্রজগৎ। মুহূর্তেই এই দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে তাঁর ভক্তদের মাঝে। নানা সূত্রের বরাত দিয়ে তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু সালমানের পরিবার প্রথম থেকেই এটি মেনে নেয়নি। সালমানকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তাঁর মা-বাবা। এ বিষয়ে মামলাও করেন তাঁরা। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছরেও কূলকিনারা হয়নি সেই মামলার। ফলে সালমান শাহর মৃত্যু হত্যা, নাকি আত্মহত্যা, সে ধোঁয়াশা আজও কাটেনি।

শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ছিলেন শুধুই তাঁর পরিবারের। কিন্তু ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ইমন নামের সেই ছেলেটি হয়ে যান সালমান শাহ। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। প্রযোজক-পরিচালকদের জন্য হয়ে ওঠেন পরম নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সেই নির্ভরতার ক্ষেত্র কেন অকালে ধ্বংস হয়ে গেল, তার কারণ আজও অস্পষ্ট।

প্রথমত, সালমান শাহ যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকেন, তবে তার পেছনে কী কারণ ছিল? তাঁর স্ত্রী সামিরা কেন কিছু বুঝতে পারলেন না? ইস্কাটনের ওই বাসায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেন স্পষ্ট করে কিছু জানালেন না? তবে তাঁর মা নীলা চৌধুরী অসংখ্যবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, সালমানের আত্মহত্যা করার কোনো কারণ ছিল না। তিনি আত্মহত্যা করার মতো দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিলেন না। আর এ জন্যই তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হন। দ্বিতীয়ত, সালমান শাহ যদি হত্যার শিকার হন, তবে কে বা কারা এর পেছনে ছিল? শুধুই কি ব্যক্তি আক্রোশ, নাকি সামষ্টিক স্বার্থের বলি হন তিনি? এর পেছনে কি শুধু দেশীয় ষড়যন্ত্র, নাকি আন্তর্জাতিক মহলের মদদ ছিল? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া আজ সময়ের দাবি।

তবে সালমানের মৃত্যু যেভাবেই বা যে কারণেই হোক না কেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে কাদের লাভ আর কাদের ক্ষতি হয়েছে, সেটি অনুসন্ধান করলেই হয়তো অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে খুব কম সময়ের মধ্যে সফলতা, জনপ্রিয়তা আর আর্থিক লাভের তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সালমান শাহ। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের চলচ্চিত্রের অবস্থাও তখন খুব একটা জুতসই অবস্থানে ছিল না। এ অবস্থায় সালমান যখন জনপ্রিয়তায় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁকে পরপারে পাড়ি দিতে হলো। বাংলাদেশের সিনেমার উন্নতি হলে কাদের ব্যবসা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা, আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ধ্বংস হলে কাদেরইবা দখলদারির সুযোগ বাড়ে—এ বিষয়গুলোও হয়তো বিবেচনাযোগ্য।

সালমানের মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা, সে বিষয়টি আদালতেই হয়তো একদিন মীমাংসা হবে। কিন্তু সালমান-হীনতায় বাংলা চলচ্চিত্রের যে ক্ষতি হয়েছে, তার রেশ এখনো টানতে হচ্ছে, হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে আরও বহু বছর।