শাহজালাল :

রোহিঙ্গা শূন্য আরকান প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছে মায়ানমার মিলিটারি। গুলি করে,জবাই করে, নির্মম খুনের খেলায় মেতে উঠেছে তারা। হাজার হাজার মুসলমান আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশ যাচ্ছে, অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, তবুও মানুষ আসছে। সীমান্তবর্তী গ্রামে, খালি পাহাড়ে, রাস্তার ধারে, পলিথিন দিয়ে কোন রকম থাকার ব্যবস্থা করছে।পানি সংকট, খাদ্য থেকে শুরু করে ঔষধ–হাহাকার সকল কিছুর। স্থানীয় জনগণ, সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিরলস ভাবে কাজ করছে। কিন্তু এত মানুষের ঢল, সাহায্য পৌছাতে দেরি হচ্ছে।

কোরবানি ঈদের আগের দিন। মানুষ বাড়ি ফিরে কিন্তু আরকানের রোহিঙ্গা মুসলমান ঘরবাড়ি, দেশ ছেড়ে ভিন দেশে শরণার্থী হয়।

খাদিজা তার ছেলে রফিক, মেয়ে রুজিনাকে নিয়ে ঘর ছাড়ে। দুপুর দুটা নাগাদ। তারা চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ জনের গ্রুপ। হাটা শুরু করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।হাটতে হাটতে অনেকদূর চলে আসে। তারা খুব ক্লান্ত। বিশ্রাম নিতে পাহাড়ের ঢালুতে বসে পড়ে। বসতে না বসতে চিৎকার দিয়ে উঠে অনেকে। গাছে ঝুলানো লাশ, একপাশে মস্তকবিহীন দেহ।অন্যপাশে মাথার স্তুপ। নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিক। পলিমাটির মত রক্তের প্রলেপ পড়েছে মাটিতে। সবাই ভয়ে আতঙ্কিত, সরে গিয়ে জড়ো হয় । মধ্যবয়স্কা নারীরা কাঁপছে, কিশোরী, যুবতি,মা, ভাই, পিতাকে ধরে আছে। তাদের সাথে আছে ৫-৬ যুবক তারাও ভীতসন্ত্রস্ত। হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে দুই শিশু। এক শিশুর বয়স ৫-৬ বছর, অন্য শিশুর বয়স দেড় বছরের কাছাকাছি হবে। তাদের দেখে খদিজা এগিয়ে যায়। খদিজাকে এগুতে দেখে ছোট শিশু দৌড় দেয় মায়ের কাছে।খদিজা দেখতে পায় গাছের সাথে দুজন বাধা।এক জন পুরুষ, তার শরীর ক্ষতবিক্ষত। আরেকজন নারী, শিশুটির মা। শিশু মায়ের উদম স্তন্য অনবরত চুষতে থাকে।
সম্ভবত এরা চার জন জীবিত আছে। পুরুষটার প্রাণ যায় যায় অবস্থা কতক্ষণ বাঁচে ঠিক নেই।
খদিজা তার ছেলের শরীর থেকে শার্ট খুলে নিয়ে নগ্ন শরীর আংশিক ঢেকে দেয়।রফিকের শরীর শিহরিয়ে উঠে।রক্তে আগুন ধরে যায়,তার কাছে তার প্রাণটা তুচ্ছ মনে হতে শুরু করে।চোখমুখ দেখলে বুঝা যায়,তার মাথায় খুন ছেপেছে। দুই যুবক বেধে রাখা পুরুষের হাতের বাঁধন খুলে দিতেই ধপাস করে মাটিতে। মুখ কাপড় দিয়ে বাধা কথা বলতে পারছে না।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। দুই বছরের শিশু মায়ে স্থনে ঢেকে দেওয়া শার্ট সরিয়ে দুধ পান করা শুরু করে।রফিক, “বুবু” বলে ডাক দেয়।তিনচার জন যুবতি আসে।তাদের সাথে থাকা ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে।
লোকটাকে ধরাধরি করে নেওয়া হয়, যেখানে বসেছিল সেখানে। শিশুটাকে কুলে নেয় খদিজা।তার মাকে কাপড় পরিয়ে দিয়ে, হাত ধরে তুলে।মনে হচ্ছিল মাটিতে পড়ে যাবে,এতই দূর্বল শরীর।কিন্তু না, সন্তানকে তড়িঘড়ি করে কুলে নিয়ে চুমু খেতে থাকে।শরীরের যেন গায়বি শক্তি ফিরে আসে।সন্তানকে কুলে নিয়ে স্বামীর কাছে ছুটে আসে। স্বামীর অবস্থা খুব খারাপ, বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। চোখে পানির শ্রুত, তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে।৫ বছরের শিশুটা মায়ের কাছে এসে বলে, মা মা ভাত দে।” হৃদয় ভেঙ্গে যায় মায়ের।কোথায় পাবে ভাত।কিভাবে তার অনাহারে থাকা শিশুর মুখে খাবার তুলে দিবে। সন্তানকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে বসে। শিশুটা মায়ের নীরবতা দেখে বলেই যাচ্ছে “ভাত দে, ভাত দে।” একজন মধ্যবয়স্কা একজন নারী শিশুটি কোলে নিয়ে বসে।তার সাথে থাকা খাবার থেকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়।
লোকটির অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে।গড় গড় শব্দ বের হয় গলা থেকে। কপাল বেয়ে বৃষ্টির মত ঘাম বের হয়। হঠাৎ মুখে “পানি”শব্দটা শুনে সবাই। এক যুবতি ব্যগ থেকে পানি বের করে দেওয়ার পূর্বে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। স্বর্গময় পৃথিবীর নরক থেকে বিদায় নিয়ে চিরদিনের জন্য স্বর্গের বাসিন্দা হন।
স্বামীর মৃত্যুতে আকাশ বাতাস কান্নার আওয়াজে ভারী হওয়ার কথা থাকলে “উ” শব্দ পর্যন্ত করলো না। তবে মুখে বিষাদের রেখা, কয়েক ফোটা ঘাম জমা হয়। সবাই চুপচাপ, কারো মুখে কথা নেই।
খদিজা যুবকদের নির্দেশ দেয় লাশটার কবরস্থ করার। কিন্তু তাদের কিছুই নেই কবর
খোঁড়ার। এক যুবক বলল পাহড়ের নিচে জমিতে কবর দেওয়ার। মাটি নরম হবে, কোন রকম হাতে খোঁড়ে কুবর দেয়া সম্ভব হবে। ঠিক তাই করা হল সন্ধ্যা নাগাদ কবর দিয়ে, তারা সবাই অন্য একটা পাহাড়ে রাত কাটায়।
পরেরদিন সকালে তাদের কয়েকজনের আনা খাবার সবাই খেয়ে হাটা শুরু করে।
পাহাড়ের পর বিলে লাইন ধরে সামনে এগুতে থাকে।তখনি শুরু হয় গুলাগুলি তাদের লক্ষ করে।তারা যে পাহাড়ে রাত কাটিয়েছে সে পাহাড়ের অন্য ঢালু থেকে।
ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়,যে যার মত দৌড়াতে থাকে। খদিজার হাতে পাঁচ বছরের শিশু।
গুলির আঘাতে কেউ কেউ বিলে পড়ে যায়।আবার কেউ ভয়ে। পাঁচ ছয় মিনিট পর গুলাগুলি বন্ধ হয়। বেশকিছু লাশ বিলে, কয়েকজন হামাগুড়ি দিয়ে সামনে যেতে থাকে।
তাদের গ্রুপ থেকে ১৫-১৬ জন নিখোঁজ। নিখোঁজের খাতায় রোজিনা ও আছে।
খদিজা রফিককে জড়িয়ে বিলাপ ধরে কাঁদে। মায়ের চেয়ে রফিক উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে।মা নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে।বলে, খোদারকসম তোর বোনকে ফিরিয়ে আন,খোঁজে আন।” তুর বোনের দায়িত্ব স্রেফ তুর উপর, জীবনের বিনিময়ে হলেও দায়িত্ব পালন কর।” মায়ের কথা শোনে তার লোম খাড়া হয়।১৫ বছরের টগবগে যুবক বিদ্রোহী হয়ে উঠে,প্রতিজ্ঞা করে। মাকে একবার জড়িয়ে চুমু দেয়।মা সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখবন্ধ করে নেয়। রফিক উল্কার বেগে ছুটে।
তাদের সাথে থাকা মধ্যবয়স্কা এক মহিলা খদিজাকে বারণ করে।
সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে না দিতে।

বিদ্রোহী বেশে, ঘোড়া ছোটার মত ছুটে। ধানক্ষেতে পড়া থাকা প্রত্যেক লাশ দেখে।কিন্তু তার বোন কোথাও নেই। হতাশ না হয়ে গুলি যেদিক দিয়ে গুলি করেছে হায়নার দল, সেদিকে যায়। নির্ভয়ে পাহাড়ের ঢালুতে উঠে। পাঁচ জন মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে।কেউ পেন্টের বেল্ট পড়ছে, কেউ মাথার চুল ঠিক করছে।একজন মাটিতে, কারো উপরে।রফিক আল্লাহ্‌ আকবর বলে মাটিতে কারো উপরে শোয়ে থাকা মিলিটারির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারিরা হতবিম্ব। রফিক সে মিলিটারির মাথা মাটিতে বেশ ক’বার আঘাত করে।গলা চেপে ধরে। নিমিষে সে প্রাণ হারায়।নিস্তেজ শরীর ছেড়ে। মাটিতে শোয়ে থাকা নগ্ন মেয়েটা তার বোন রোজিনা। রোজিনার ডান গালের তিলটা নেই, তিল সহ ডান
Shah Jalal
গালের কিছু অংশ কামড়িয়ে তুলে নিয়েছে পিশাচরা।বোনের মাথায় হাত দিয়ে বোকে জড়িয়ে ধরে।মাথার নিচের অংশে একটা ক্ষত।মৃত্যু হয়েছে অনেকক্ষণ পূর্বে। বোনের প্রাণহীন শরীরের উপর পশুরা এতক্ষণ পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।রফিক বোনকে মাটিতে রেখে দুজন মিলিটারির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।দুহাতে দুজনের মাথা মাটিতে আঘাত করতে থাকে।তার পেশিতে অলৌকিক শক্তি এসেছে। দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারি রফিকের শরীরে ছুড়ি চালাতে থাকে। রফিককে থামাতে ব্যর্থ হয়ে তার উপর বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে।গুলিতে রফিক সহ মিলিটারি দুজন মারা যায়।”আমাকে ক্ষমাহিকরো মা, আমি পারলাম না। আমায় ক্ষমা কর”।বলে রফিক শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।দুজন মিলিটারি তার মৃত দেহ ছোড়ে ফেলে পাহাড় থেকে। গড়িয়ে পড়ে নিচে।