কায়সার হামিদ মানিক,উখিয়া সীমান্ত থেকে ফিরে :
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্টে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গত ১০ দিনে দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদনে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার কথা বললেও বাস্তবে এর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে।
এর মধ্যে গত রোববার (০৩ সেপ্টেম্বর) এক রাতের ব্যবধানেই টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা। যদিও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বলছেন, এক রাতের ব্যবধানে রোববার নতুন করে অন্তত ১৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।
এদিকে, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা এসব রোহিঙ্গা প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পাচ্ছেন না। খাবার ও পানির তীব্র সঙ্কটে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন তারা।
সেই সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশা রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড়-সমতল ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
অচিন এলাকায় যে যেখানে পারছেন সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নিচ্ছেন। ফলে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠছে ঝুপড়ি ঘর।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নতুন করে কয়েক হাজার ঝুপড়ি ঘর তৈরি করেছে নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা। সেই সঙ্গে প্রতিদিন বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। যে যেখানে পারছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমান্ত এলাকার এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ঈদের দিন ঘুমধুম সীমান্তে জাফর-আয়েশা দম্পতি মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে খুন হওয়ার পরই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। প্রতিটি সীমান্ত দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে। শিশু-বৃদ্ধদের কোলে-কাঁধে করে নিয়ে আসছে তারা। যেসব সীমান্তে বিজিবির কড়া অবস্থান রয়েছে সেখানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে রোহিঙ্গা। রাতে কিংবা বৃষ্টিতে যে যার সুযোগ মতো বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। গত কয়েকদিনে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে রোববার রাতে ঢুকেছে ২০ হাজারেরও বেশি।
এদিকে, সীমান্তের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। রোহিঙ্গা হিন্দুদের বর্তমান অবস্থা ঘুরে দেখেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।
সীমান্ত এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত সময়ের চেয়ে এবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক বেশি। উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার বন বিভাগের জায়গা দখল করে আরও ৩টি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। ফলে সীমান্ত এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী ঢালার বাসিন্দা আবুল কালাম, জসিম উদ্দিন, উখিয়ার কর্মরত দুই সাংবাদিক কায়সার হামিদ মানিক,শ.ম গফুর বলেন, রোহিঙ্গারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। নতুন করে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরা সহায়-সম্বল রেখে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে আশ্রয় নিলেও বাঁচার তাগিতে আগের রোহিঙ্গাদের মতো এরাও অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফর আহাম্মদ বলেন, আমার সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে পারেনি। যারা এসেছে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের মুখে গণহত্যা-গণধর্ষণ-নির্যাতন থেকে বাঁচতে গত ১০ দিনে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু এর সংখ্যা দ্বিগুণ বলে দাবি করেছে স্থানীয় সংস্থাগুলো।
কুতুপালং ও বালুখালী এবং লেদা রোহিঙ্গা বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী মাঝিদের দাবি, তাদের একেক বস্তিতে নতুন করে ৫০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে থাইংখালীতে বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি।
কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের মাঝি আবু ছিদ্দিক ও মুহাম্মদ নূর বলেন, আমাদের ক্যাম্পে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অর্ধ লাখেরও বেশি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। বলতে গেলে এর সংখ্যা ৬০-৭০ হাজারের কম নয়। পুরনো যে দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির- কুতুপালং এবং নয়াপাড়া- তাতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
এদিকে, নতুন ব্লকের দায়িত্বশীল আবদুল্লাহ জানান, টিভি টাওয়ারের আশপাশে অন্তত ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নতুন করে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে অবস্থান নিয়েছে।
বালুখালী ক্যাম্পের মাঝি ইলিয়াছ ও ছৈয়দ নূর জানান, তাদের ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকায় নতুন করে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। যে যেভাবে পারছে, যেখানে পাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে। যখন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে এসব ক্যাম্পে আসে তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে না বলেও জানান তারা।
নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন আশঙ্কাজনকহারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এর সংখ্যা এক লাখের বেশি।
আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ঢুকেছে। তবে দেড় লাখ হবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। যেভাবে রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে এর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে বেশি সময় লাগবে না বলেও জানান তিনি।