শাহ জালাল :

সাবের আলী ১৩ বছরের রোহিঙ্গা কিশোর। ২৫ আগস্ট মায়ানমার মিলিটারির গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।বাংলাদেশের কুতুপালং শরণার্থী শিবির এখন তার আশ্রয়সস্থল। অসম্ভব সুন্দর ও মেধাবী, দুরন্ত কিশোর। আজ বাক্যহীন, নিস্তব্ধ। চোখেমুখে অমাবস্যার অন্ধকার। যেখানে যায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে,কথা বলেনা।

ছোট বেলা থেকে কোরবানি ঈদে গরু জবাই করার দৃশ্য তার অসম্ভব ভালো লাগে। ঘুরতে ঘুরতে সে যেখানে গরু জবাই হয় সেখানে দাঁড়ায়। সে লক্ষ করে, তার শরীরে নতুন জামা নেই, নেই সুগন্ধি। কাপড় থেকে অদ্ভুত গন্ধ বের হচ্ছে, গভীরভাবে গন্ধ নিলে বমি হওয়ার সম্ভবনা আছে। তাদের বাড়িতে প্রতি বছর কোরবানি ঈদ বড় গরু কোরবানি দেয়া হত। অন্যদিকে আজ কাদের গরু জবাই হচ্ছে তাও জানেনা। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গরু জবাই করার দৃশ্য দেখতে থাকে।যখন গরুর গলায় ছুড়ি চালানো হয় সে, “বাপজান ” বলে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।তাকে দেখার কিংবা তুলার জন্য কেউ আসেনা।যে যার কাজে ব্যস্ত।কিছুক্ষণ পর এক যুবক এসে মাথায় পানি দিয়ে হুশ করে। জানতে চাই,” ক্যাম্পের কোন ব্লকের?” সাবের মাথা নেড়ে জবাব দেয় “জানিনা”। যুবক সাবেরকে প্রশ্ন করে, ‘কোথায় থাকো? ” সাবের বলে, ” আসার পর থেকে স্কুলের বারান্দায় ও মসজিদের বারান্দাতে।”

যুবকের পরিবার ১৯৯২ সালে মায়ানমার মিলিটারির নারকীয় হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে শরণার্থী হয়েছিলো। তার জন্ম শরণার্থী শিবিরে। বেড়ে উঠা, শৈশব,কৈশর, শিক্ষাদীক্ষা, সবকিছু এই শিবিরে।
শরণার্থী শিবির যেন তার পৃথিবী।তার পিতার কাছে শুনেছে মায়ানমার সামরিক জান্তার নির্মম নির্যাতনের কথা।
কিন্তু এইবারের গণহত্যা অন্যবারের চেয়ে যে হাজার হাজার গুণ বেশি চালাচ্ছে মিলিটারি বাহিনী । তা নিশ্চিত সে।
যদিও সে স্বচোক্ষে প্রত্যক্ষ করেনি।
বাংলাদেশে মানুষের ঢল, ক্ষতবিক্ষত শরীর, গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনা, মা হারা সন্তানের কান্না, সন্তান হারা মায়ের অাত্মচিৎকার, স্বজন হারাদের বিলাপ।
ধর্ষিত কিশোরী, যুবতীদের অর্তনাদের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী সে।

তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে দাগ কাট সাবেরের নিঃস্বপাপ অসহায় চেহারা। যুবক সাবেরের হতা ধরে হাটতে শুরু করে।শরণার্থী শিবিরের থেকে বের হয়ে, দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে। খাবার নিয়ে রাস্তার ধারে, গাছেরর ছায়ায় বসে দুজনে। সাবেরের হাতে খাবার তুলে দেয় যুবক।খাওয়া শেষ হলে, সাবেরকে লক্ষ করে বলে, ” বাড়ি কোথায়?,কিভাবে এসেছো? পিতামাতা, কি ঘটেছিলো সেদিন? ” আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে।
সাবের চুপ!
মিনিট পাঁচেক পর বলা শুরু করে।
“পিতামাতার একমাত্র সন্তান আমি।পিতার কলিজ্বর টুকরা,মায়ের জান।বাড়ির চারপাশে ফলের বাগান। বাড়ির দুই দিকে পুকুর।গোয়ালে দু ডজনের কাছাকাছি গরু মহিষ। ১০ একর জমি,৫ একর জমি লোক দিয়ে চাষ করান আব্বা।বাকী জমি বর্গা দিয়ে দেন। সব মিলিয়ে আমাদের সুখি পরিবার।”

যুবক সাবেরের মুখপানে চেয়ে থাকে মুখে হাত দিয়ে।সাবের বলতে থাকে।

২৫ আগস্ট দুপুরের দিকে আব্বা লালুকে ( গরুকে আদর করে লালু ডাকা হয়) গোসল করাচ্ছেন। লালুকে কোরবানি ঈদে কোরবানি দেওয়ার কথা ছিলো।আমি পুকুর পাড়ে বসেছিলাম গোসল করার জন্য। আব্বা গোসল করিয়ে গোয়াল ঘরে বেধে আসেন লালুকে। বাড়ি থেকে লুঙ্গি নিয়ে পুকুর ঘাট আসছিলেন। প্রতিদিন আব্বার সাথে গোসল করি। আব্বা উঠানের মাঝখানে আসলেন।
তখনি, একদল মিলিটারি উঠানে প্রবেশ করে।আব্বা তাদের দিকে এগিয়ে যায়।আব্বা এগিয়ে গেলে দুজন মিলিটারি মাথায় আঘাত করে।মাটিতে পড়ে যান আব্বা।
তারা দুজন হাতপা ধরে জবাই করে দিতে প্রস্তুত। তখন চারিদিকে গুলাগুলি হচ্ছে।
আব্বা চিৎকার দিয়ে বলে, “সাবের পালা”। কথা শেষ হতে না হতে আব্বার গলা দিয়ে রক্তের শ্রুত বয়তে শুরু করে।
সাবেরের কথা শুনে যুবক কেঁদে উঠে, সাবের চুপ।
যুবক সাবেরের হাত ধরে তুলে হাটতে শুরু করে শরণার্থী শিবিরের দিকে।তখন মসজিদের মাইকে সু-মধুর সুরে আযান হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরে ডুকে পড়ে তারা।
বাড়ি পৌছানোর পূর্বে যুবক সাবেরকে প্রশ্ন করে, মায়ের কি হয়েছিলো?
সাবের বলে,” জানিনা।” আব্বাকে জবাই করলে আমি পালিয়ে আসি।
কিছুদূর আসার পর দেখি আকাশের দিকে আগুনের ফুলকি উঠতে।সারা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারি। ”
আর কিছুই জানিনা”

সাবের সবকথা খুব স্বাভাবিক ভাবে বর্ণনা করেছে। তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য একফোঁটা জল আসেনি। খুব অউদ্ভূত বিষয়!

শাহজালাল

যুবক সাবেরের হাত ধরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।
যুবকের ৫ সদস্যের পরিবার। ছোট ছোট তিন রুমে এখন ১৭ জন থাকে। খুব কষ্টে ঘেঁষাঘেঁষি করে সুখেই থাকে! তারা দুজন ভেতরে ঢুকে মেঝেতে বসে। মেঝেতে থাকা হয়, মেঝেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। যুবকের মা, ছেলে ঢুকামাত্রইই খাবার বন্দোবস্ত করেন। তারা দুজনের জন্য খাবার আনা হয়। হাত ধোয়ে খাবার খেতে ভাত নেয় প্লেটে সাবের।যুবকের মা সাবেরের নিঃপ্রাণ চেহারা, অসহায় মুখ লক্ষ করে। নিজের হাতে বাটী থেকে দুই টুকরা মাংস তুলে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”বাজান খা”। সাবের নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা “বাপজান” শব্দ শুনে। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে সে। অজর নয়নে জল গড়িয়ে পাড়তে থাকে প্লেটে, তরকারি মাখা ভাতে জল মিশে যায়।
চোখেরজল না মোছে, জল মেশানো ভাত খেতে থাকে সাবের।