ইমাম খাইর, সিবিএন:
অনিকা বালা (লাল ওড়না), বয়স ১৫। সে ছয় মাসের সন্তান সম্ভবা। বার্মা মিলিটারি তার স্বামীকে কেটে ফেলেছে। অপরজন স্বরস্বতি, বয়স ১৮। বিয়ে হয়নি। তার বাবা-মা দুইজনকে মেরে ফেলেছে মিয়ানমারের পাষান বাহিনী।

জীবন বাঁচাতে সীমান্ত সাঁতরিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এপারে। ওপারে সর্বহারা অনিকা ও স্বরস্বতি এপারে স্বজনহীন। অন্ধকার দেখছে দু’চোখে। তাদের প্রশ্ন, কি অপরাধ স্বজনদের? কেনইবা খুন করা হলো তাদের? মিয়ানমার মিলিটারির গুলির আওয়াজ আর ববর্বর আচরণ প্রতিমূহুর্তে তাড়িয়ে বেড়ায় অনিকা-স্বরস্বতিকে!!

এভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেনা সনাতন ধর্ম্বালম্বী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী ও শিশুরাও। তাদের উপর চলছে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ। প্রাণের ভয়ে স্বদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে মুসলিম অধ্যূষিত আরাকানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সনাতন ধর্ম্বালম্বীরা। তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া কুতুপালং হরি মন্দির এলাকার বিভিন্ন বসতবাড়িতে।

সীমান্তে অন্য রোহিঙ্গাদের সাথে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা অসহায় হিন্দুরা বর্মিবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনের নৃশংসতার বর্ণনা দেন।

মগদের নির্যাতনে পালিয়ে আসা অনিকা বালা (লাল ওড়না) ও স্বরস্বতি।

আশ্রয় নেয়াদের একজন মিয়ানমারের মংডু এলাকার ফকিরাবাজারের নিকুঞ্জের ছেলে রঞ্জিতের স্ত্রী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা নয়, আমাদের নির্যাতন করছে মগ ও রাখাইনেরা। তারা সেখানে বোমা হামলা করছে, কিরিছ দিয়ে মানুষ কাটছে। রোহিঙ্গা মুসলমানেরা আমাদের এখানে আসার জন্য সহযোগিতা করেছে।

আশ্রয় নেয়া এসব হিন্দু নারীরা জানিয়েছেন, আরকানের রাখাইন ও মগেরা শুধু মুসলমানদের হত্যা করছে, তা নয়। আমাদের স্বামীদের মুসলামনা হত্যাযজ্ঞে রাখাইনদের সাথে যোগ দিতে বলেছিল। কিন্তু আমাদের স্বামীরা তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের বিরুদ্ধেও হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। অনেক হিন্দুকে তারা মেরে ফেলেছে।

আশ্রয় নেয়াদের একজন রমা কর্মকার জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার রিকটা নামের গ্রাম থেকে দুই শিশু সন্তান নিয়ে তিনি এসেছেন। তাদের গ্রামে তার স্বামীসহ অনেক পুরুষকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। এই দৃশ্য তারা দেখেছেন। তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে নারী এবং শিশুদেরও নির্যাতন করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেকারণে এই নারীসহ গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলো সব পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।

এদিকে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে এসে উখিয়ার কুতুপালং হরিমন্দির এলাকায় আশ্রয় নেয়া লোকদের খোঁজ খবর নিতে যান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ব খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন, প্রচার সম্পাদক চঞ্চল দাশ গুপ্ত, অর্থ সম্পাদক স্বপন গুহ এর নেতৃত্বে সনাতন ধর্ম্বালম্বীদের একটি টিম। তারা নির্যাতনের শিকার স্বধর্মীয় লোকদের খোঁজ খবর নেন এবং সার্বিক সহয়তার আশ্বাস দেন।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার রিকটা গ্রাম ছাড়াও চিয়ংছড়ি এবং ফকিরাবাজার গ্রামে ছিল হিন্দুদের বসবাস। এই তিনটি গ্রাম থেকে নির্যাতনের কারণে হিন্দুরা পালিয়ে সীমান্তে এসেছেন।

হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় নেতা প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন জানিয়েছেন, উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে অল্প দূরত্বে একটি মন্দিরে এবং তার আশে পাশে আশ্রয় নিয়েছেন পালিয়ে আসা ৪১২জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। তাদের মধ্যে কয়েকজন বৃদ্ধ ছাড়া বাকিরা নারী এবং শিশু।
কক্সবাজারের জেলাপ্রশাসনও তাদের আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

তিনি আরও বলেছেন, কয়েকশ সীমান্তে জিরোলাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে অবস্থান করছেন।

সুত্র জানায়, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর দপ্তর থেকে প্রকাশিত স্টেটমেন্ট অনুযায়ী মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছে, আরাকানে ছয়জন হিন্দুকে হত্যা করেছে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।

কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রিত হিন্দুরা বলেছে, বিপরীত কথা। রোহিঙ্গারা নয়, তাদের হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনেরা।

এ ছাড়া গত ২৪ আগস্ট রাত থেকে শুরু হওয়া বর্মি সামরিক বাহিনীর কিলিং অপারেশনে যেসব নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে অর্ধশতাধিক হিন্দুও রয়েছে বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা হিন্দুরা।

তারা জানিয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলিমের পাশাপাশি হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়েছে মিয়ানমারের বর্ববর বাহিনী। মুসলিম যুবকদের পাশাপাশি হিন্দু পুরুষদের ওপর বেপরোয়া গুলি করছে সেনারা।

রোহিঙ্গা ৩০ হাজার, হিন্দু ৪১২:
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে নতুন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ৩০ হাজার অতিক্রম করেছে। যার মধ্য ৪১২ জন নতুন হিন্দু রোহিঙ্গা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিভাসন সংস্থা (আইওএম)এর হিসেবে শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৮ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে।
বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ৩০ হাজার অতিক্রম করেছে বলে বিভিন্ন সংস্থা নিশ্চিত করেছে। এর মধ্য নতুন হিন্দু রয়েছে ৪১২ জন।
কুতুপালং হরি মন্দির সংলগ্ন স্থানে হিন্দুরা অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত করেছেন হিন্দু কল্যাণ ট্টাস্টি বোর্ডের সদস্য প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন।