হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :

শাহপরীরদ্বীপে ব্যাপক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে ‘কক্সবাজার নিউজ ডট কম’র সংবাদ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ৩০ আগষ্ট উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ নাফ নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনা ও লাশ উদ্ধারের পর সাবরাং ও শাহপরীরদ্বীপে চোরাইপথে আদম পারাপারের ৭টি ঘাটে ৩৬ জন দালাল সক্রিয় বলে প্রশাসনকে সতর্ক করে আগেই ‘সিবিএন’ এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্ত যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় এ অঘটন ঘটেছে। আগের দিনের সেই আশংকায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ১ রাতেই শাহপরীরদ্বীপে ২০ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে।

দালালদের তৎপরতায় ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে শাহপরীরদ্বীপে ফের রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১০ জন শিশু এবং ৯ জন নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ২ দিনে নৌকাডুবিতে লাশের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৩ জন। ৩১ আগস্ট বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম সৈকত এলাকায় ফের রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির এ ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা নিখোঁজ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডুবে যাওয়া ট্রলারটি শাহপরীরদ্বীপ ডাঙ্গরপাড়া এলাকার আবদুস শুক্কুরের মালিকানাধীন বলে স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঈন উদ্দীন খান জানিয়েছেন, নৌকা ডুবির ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। এসব লাশ উদ্ধারে পুলিশের একটি টিম শাহপরীরদ্বীপে অবস্থান করছে।

সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ ইউপি সদস্য নুরুল আমিন জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাটি ঢেউয়ের কবলে পড়ে ডুবে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকালে স্থানীয় লোকজন শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিম সৈকত থেকে এদের লাশ উদ্ধার করেছে। এতে অনেকে নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা যায়। তিনি আরও জানান, ডুবে যাওয়া নৌকাটি রোহিঙ্গা লোকজন নিয়ে আসে। তবে অন্য রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে বলা যাচ্ছেনা। লাশ পাওয়া বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা মোতাবেক ১৯ জন মৃত দেহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি। মৃত দেহের মধ্যে নারীদের বয়স ১ জনের ৬০, বাকী ৮ জনের ৩৫ থেকে ৪৫ বছর, ৭ জন শিশু কন্যা সন্তানের বয়স ৪ বছরের নিচে এবং ৩ জন ছেলে শিশুর বয়সও ৪ বছরের নীচে। তাদেরকে এখনও শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিম পাড়ায় রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, আগের দিন ৩০ আগস্ট নৌকা ডুবিতে দুইজন শিশু ও দুইজন নারী মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ২ দিনে নৌকাডুবিতে লাশের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৩ জন।

এদিকে পাচারকারী চক্র অর্থের লোভে রোহিঙ্গা পাচারে মেতে উঠেছে। পাচারকারীরা অর্থের লোভ দিয়ে মাছ ধরার নৌকা গুলোকে ব্যবহার করছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শাহপরীরদ্বীপের পাচার চক্র সাগরে মাছ ধরার ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করে রাতের আধারে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে শতাধিক নৌকা মাছ ধরার বাহানা দিয়ে রোহিঙ্গা আনতে সাগরে পাড়ি জমায়। এসব নৌকা রোহিঙ্গা বোঝাই করে আসার পথে সাগরের কূলে ভিড়ানোর সময় ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে গিয়ে এ ঘটনা ঘটছে।

আগের দিন ৩০ আগস্ট রাতে শাহপরীরদ্বীপে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার প্রস্ততি বিষয়ে দালালদের তৎপরতা সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনকে আগেই অবহিত করা হয়েছিল। কিন্ত যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় এ অঘটন ঘটেছে। আগের দিনের সেই আশংকায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ১ রাতেই শাহপরীরদ্বীপে ২০ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।

প্রসঙ্গতঃ টেকনাফের সাবরাং ও শাহপরীরদ্বীপে চোরাইপথে আদম পারাপারের ৭টি ঘাটে ৩৬ জন দালাল সক্রিয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া সাবরাং মানব পাচারের এয়ারপোর্ট খ্যাত খুরেরমুখ, কাটাবনিয়া ও নয়াপাড়া ৩টি ঘাটে আরও বেশ কয়েকজন সক্রিয় দালাল। এদের কাজ হচ্ছে মানবতার দোহাই দিয়ে মাথাপিছু বাংলাদেশী ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে চোরাইপথে বাংলাদেশে নিয়ে আসা। এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক ৩০ আগস্ট বুধবার দুপুরে দালালদের ধরতে সাবরাং অভিযান পরিচালনা করেছেন।

জানা যায়, সাগর দিয়ে চোরাইপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের এয়ারপোর্ট খ্যাত ছিল শাহপরীরদ্বীপ, খুরেরমুখ ও কাটাবনিয়া। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমুহের অব্যাহত অভিযানে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার বর্তমানে শুন্যের কোটায়। এখন শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (রাখাইন স্টেট) অব্যাহত সহিংস ঘটনায় মিয়ানমার থেকে দলে দলে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। বিজিবি, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের হাতে আটক হচ্ছে। তাঁদের ভাষায় মানবিক সহায়তা (খাবার, ঔষধ, পানি) দিয়ে পুশব্যাক করা হচ্ছে। সীমান্তের আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রতিরোধ সত্বেও উল্লেখিত ঘাট সমুহের দালালদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার অপেক্ষায় আছে।

সেন্টমার্টিনদ্বীপ থেকে হোয়াইক্যং পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের মোহনা এবং নাফ নদীর প্রশসস্থতা তুলনামুলক বেশী চওড়া। ইচ্ছামত তাড়াতাড়ি অল্প সময়ের মধ্যে এপারে চলে আসার সুযোগ কম। উপরন্ত এই সীমান্তে বিজিবি, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সজাগ-সতর্কতা বেশী। তাই ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (রাখাইন স্টেট) অব্যাহত সহিংস ঘটনার পর সেন্টমার্টিনদ্বীপ থেকে হোয়াইক্যং পর্যন্ত সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে তুলনামুলক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কম ঘটেছে।

কিন্ত পরিস্থিতি দালালদের কারণে খুব দ্রুত পাল্টে গেছে। সেন্টমার্টিনদ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ছে।

বিশেষ করে শাহপরীরদ্বীপ থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে বলে গোপন সুত্রে খবর পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের এনে সুযোগ বুঝে সেন্টমার্টিনদ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ, নয়াপাড়া, খুরেরমুখ, কাটাবনিয়া, মহেশখালীয়াপাড়া, তুলাতলী, লম্বরী, মিঠাপানিরছড়া, রাজারছড়া, শীলখালী, শামলাপুর, মনখালী, ছেপটখালী, ইনানীসহ বাংলাদেশ উপকুলের বিভিন্ন পয়েন্টে নামিয়ে দেয়া হবে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (রাখাইন স্টেট) অব্যাহত সহিংস ঘটনায় মিয়ানমার থেকে ২টি নৌকা বোঝাই করে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। তম্মধ্যে ১টি নৌকায় ১৯ জন এবং আরেকটিতে ২৫ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু ছিল। ২টি নৌকার মধ্যে ১টি শাহপরীরদ্বীপ মিস্ত্রীপাড়া ঘাটের নৌকা। ৩০ আগষ্ট সকালে উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ এলাকার লোকজন নাফনদীর পশ্চিমপাড়া সীমান্তের কিনারায় ৪টি মৃত দেহ দেখতে পেলে স্থানীয় বিজিবিকে খবর দেয়। খবর পেয়ে একদল বিজিবির উপস্থিতিতে স্থানীয় লোকজন দুই শিশু ও দুই নারীসহ ৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। মৃত দেহগুলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এরপর টেকনাফ থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। শাহপরীরদ্বীপ মিস্ত্রীপাড়া, জেটিঘাট, ঘোলারপাড়া ও জালিয়াপাড়ায় এ ৪টি আদম পারাপারের চোরাই ঘাটে ৩৬ জন দালাল সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তম্মধ্যে জালিয়াপাড়া ঘাটে ১৫ জন, ঘোলাপাড়া ঘাটে পিতা-পুত্র মিলে ৪ জন, জেটি ঘাটে ৩ জন এবং মিস্ত্রীপাড়া ঘাটে ১৪ জন। তাছাড়া সাবরাং মানব পাচারের এয়ারপোর্ট খ্যাত খুরেরমুখ, কাটাবনিয়া ও নয়াপাড়া ৩টি ঘাটে আরও বেশ কয়েকজন সক্রিয় দালাল।

সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান স্থানীয় কিছু ট্রলার মালিক বিজিবি পুলিশ ও কোস্টগার্ডের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমারে গিয়ে অবৈধভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করার তৎপরতা চলছে। বিশেষ করে ৩০ আগস্ট সকালে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ সৈকত থেকে ৪ রোহিঙ্গা নারী-শিশুর ভাসমান লাশ উদ্ধার করার ঘটনার পর প্রশাসন আরও বেশী তৎপর হয়ে উঠেছে। দেশের স্বার্থে পুরো বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করে কারা এসব অবৈধ কাজের সাথে জড়িত প্রশাসনের কাছে এদের তালিকা দেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান ট্রলার মালিকদের অপতৎপরতার বিষয়টি জানতে পেরে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক ৩০ আগস্ট বুধবার দুপুরে সাবরাং অভিযান পরিচালনা করেন। তবে কোন দালালকে ধরতে পারেননি। আগের দিন ২৯ আগস্ট ২ জন দালালকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য, গত ১৯ আগস্ট শনিবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন টেকনাফে এসে জরুরী আইন শৃংখলা সভা করে যে কোন মুল্যে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করতে কঠোরভাবে নির্দেশ এবং এ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুশিয়ারী দিয়েছিলেন। ##