মিরাজ রিপন :

( জাতির পিতার ইন্টারভিউ -পর্ব১)

১৯৭২ সালের জানুয়ারি, ঢাকা। ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের অনুলিখন সন্নিবেশিত হয়। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় এই সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনের ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন্ বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি প্রদর্শিত হয়।

ডেভিড ফ্রস্ট: সে রাতের কথা আপনি বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলোচনা এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই রাতের কথা বলুন। সেই ২৫শে মার্চ, রাত ৮টা। আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িতেই পাকিস্তানি বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু আপনি আপনার বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেফতার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেলেন না এবং গ্রেফতার বরণ করলেন? কেন এই সিদ্ধান্ত? তার কথা বলুন।

শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, সে এক কাহিনী। তা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তান বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে, ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। এক হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাধা করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।

ফ্রস্ট: আপনি হয়তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন।

শেখ মুজিব: আমি ইচ্ছা করলে যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।

ফ্রস্ট: আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ এ ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ।

শেখ মুজিব: আমি তা বলিনে। কিন্তু এ কথা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল। আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন, গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। বাবা-মার আর কোনো আশ্রয় রইল না। ওরা সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি শক্তিশালী সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়তো এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।

ফ্রস্ট: আপনাকে ওরা ঠিক কী ভাবে গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত ১-৩০ ছিল? তাই নয় কি? তখন কী ঘটল?

শেখ মুজিব: ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।

ফ্রস্ট: ওরা যখন এলো, তখন আপনি বাড়ির কোনখানটাতে ছিলেন?

(আসছে—–)

[ড্যাভিড ফ্রস্ট(৭ এপ্রিল ১৯৩৯-৩১ আগস্ট ২০১৩) একজন লেখক,সাংবাদিক,কমেডিয়ান, টিভি উপস্থাপক। “]

ইংরেজী ভাষা থেকে অনুবাদকৃত সাক্ষাৎকারটি।