রফিক মাহমুদ, উখিয়া, সীমান্ত থেকে ফিরে

বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের উখিয়া ও ঘুমধুম ঢেকুবনিয়া এলাকায় শনিবার বিকেল ৪টার থেকে প্রচন্ড গুলিবর্ষণে পুরো এলাকা চরম অতংক ও উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। মায়ানমারের আইন শৃংখলাবাহিনীর অর্তকিত গুলিবর্ষণে উখিয়ার সীমান্ত এলাকা বালুখালী ও ঘুমধুম তুমব্রু ঢেকুবনিয়া এলাকা ও সীমান্ত জনপদ জুড়ে সাধরন লোকজনের মাঝে উদ্বেগ ও অজনা আতংক দেখা দিয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন গতকাল সকাল ১০টায় উখিয়া উপজেলা পরিষদ হল রুমে এক জরুরী সভায় প্রশাসন সহ আইন শৃংখলা বাহিনীর সকলকে কড়া সর্তক অবস্থায় থেকে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল মঞ্জুর হেলালী সাংবাদিকদের জানান, বালুখালী, ঘুমধুম তুমব্রু বেতবনিয়া এলাকার বাসিন্দারা মায়ানমারের সীমান্ত বাহিনীদের মুহু মহু প্রচন্ড গুলিবর্ষনের ঘটনায় সীমান্ত এলাকার সাধারন মানুষের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। ঘর-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিচ্ছে। বালুখালী গ্রামের মেম্বার নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, মায়ানমারের বাহিনী বিকেলে একের পর এক গুলিবর্ষণ শুরু করলে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাণের ভয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিচ্ছে।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিরি অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান জানান, সীমান্তের যে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন ও টহল জোরদার বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এদিকে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে মুসলিম রোহিঙ্গারা। রাতের আঁধারে বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন। বিজিবির কড়া নজরদারির মাঝেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

গতকাল সকাল থেকে সরজমিনে, উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, উলুবনিয়া ও টেকনাফের হোয়াইক্যং, লম্ববিল, উনছিপ্রাং, ঝিমংখালী, খারাংখালী, হ্নীলার পুলের ডেইল, রঙ্গীখালী ও চৌধুরীপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। শুক্রবার বিকেলে নাফ নদী পাড়ি দেওয়া প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে বিজিবি ঠেকাতে পারলেও রাতের বেলা তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

শনিবার ভোরের আলো ফোটার পর থেকে ওই এলাকায় তাদের আর দেখা যায়নি। হোয়াইক্যং’র সিএনজি চালক নুর মোহাম্মদ জানান, রাতের আঁধারে সিএনজি, মাহিন্দ্রা ও টমটম যোগে দলে দলে রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। তারা নিজেরাই এসব ভাড়া মেরেছেন বলে জানান নুর মোহাম্মদ।

এদিকে লেদা শরণার্থী ক্যাম্পের বস্তি কমিটির নেতা আনোয়ার হোসেন জানান, মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ৬ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তারা টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদা, উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পেগুলোতে অবস্থান করছে বলেও জানান তিনি ।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৮৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৭৭ রোহিঙ্গা মুসলিম ও নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য রয়েছেন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা পুলিশ পোস্টে হামলা এবং একটি সেনাঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করলে এ সংঘর্ষ বাঁধে। এরপর শুক্রবার মায়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে গুলি করে হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

মায়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকালে ৭৩ রোহিঙ্গাকে ফেরত:

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। শুক্রবার রাত ৯টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কোস্টগার্ড ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা নাফ নদী দিয়ে টেকনাফে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।

কোস্টগার্ডের শাহপরীর দ্বীপ স্টেশনের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার সোলেমান কবির বেলা সাড়ে ১১টায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, নাফনদীজুড়ে কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে। মায়ানমারের মংডু এলাকা থেকে নারী শিশুসহ ৫৬ রোহিঙ্গাকে বহনকারী একটি নৌকা বাংলাদেশে ঢুকছিল। এসময় একই পয়েন্ট দিয়ে তাদের মায়ানমারে ফেরত যেতে বাধ্য করা হয়। টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ উপজেলার কয়েকটি এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশ করা চারজন শিশু, আটজন নারী, পাঁচজন পুরুষসহ ১৭ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করা হয়। তিনি আরও বলেন, নাফনদী ও পুরো সীমান্ত এলাকায় বিজিবি সতর্ক পাহারায় রয়েছে। যারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের আটক করে পুনরায় নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে।

কোস্টগার্ড ও বিজিবি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের ২০৮ কিলোমিটার স্থল ও ৬৩ কিলোমিটার জলসীমানা রয়েছে। গত দুই দিনে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ২১৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

একটি বেসরকারি সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় ১১ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করে উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং এবং টেকনাফের লেদা ও মুছনি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সরকারিভাবে এর কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে।