বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল রাজ্জাক। তাকে ছাড়া এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে কল্পনাই করা যায় না। অথচ সেই তিনিই হতে চেয়েছিলেন খেলোয়াড়- তুখোড় গোলরক্ষক, গোলপোস্টের নির্ভরতা! কিন্তু নিয়তি তাকে করে দিলো অভিনেতা।
রাজ্জাক তখন থাকতেন কলকাতায়। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। পড়াশোনা করতেন খানপুর হাইস্কুলে। স্কুলে ফুটবলের নেশা পেয়ে বসেছিল তাকে। পড়ার বাইরে তাকে মাঠেই পাওয়া যেত বেশিরভাগ সময়।
ওই সময় স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাটকে অাধিপত্য ছিল মেয়েদের। মেয়েরাই অভিনয় করত। শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক করলেন, ছেলেদের দিয়ে নাটক করাবেন। এর জন্য তিনি বেছে নিলেন নারী চরিত্রবর্জিত নাটক ‘বিদ্রোহী’।
তাহলে এবার হিরো হবেন কে? রাজ্জাক তখন বুঁদ হয়ে আছেন ফুটবল ম্যাচে। শিক্ষকের নির্দেশ, ‘ওকেই ধরে নিয়ে আয়!’ এরপর নামিয়ে দেওয়া হলো নাটকে।
ব্যস, এভাবেই গ্রামীণ কিশোর চরিত্রের মাধ্যমে নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। শুরু হলো নতুন পথচলা, যে পথ তাকে দিয়েছে নায়করাজের মুকুট।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান রাজ্জাক। প্রথমদিকে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সুযোগ পান আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার। পরে সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হাজির হন চলচ্চিত্রের পর্দায়। প্রথম সেই অভিনয়েও রাখেন নিজের সুঅভিনয়ের স্বাক্ষর। পরবর্তীকালে ‘কার বউ’, ‘ডাক বাবু’, ‘আখেরী স্টেশন’সহ আরও বেশ ক’টি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেন। পরে ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ঢালিউডে নায়ক হিসেবে তার সদর্প উপস্থিতি। প্রায় তিনশ বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। পরিচালনাও করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়েই তিনি অর্জন করেন নায়করাজ খেতাব। অর্জন করেন একাধিক সম্মাননা। তিনি বেশ ক’বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন।রাজ্জাক (১৯৪২-২০১৭ )

তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘আকাঙ্ক্ষা’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘পাগলা রাজা’, ‘বেঈমান’, ‘আপনজন’, ‘মৌ চোর’, ‘বদনাম’, ‘সাত ভাই’, ‘চাঁপা ডাঙ্গার বৌ’, ‘জীনের বাদশা’, ‘ঢাকা-৮৬’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘মরণ নিয়ে খেলা’, ‘সন্তান যখন শত্রু’, ‘আমি বাঁচতে চাই’, ‘কোটি টাকার ফকিরে’র মতো জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল সব চলচ্চিত্র।
রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে— ‘স্লোগান’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘অতিথি’, ‘কে তুমি’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘পলাতক’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘খেলাঘর’, ‘চোখের জলে’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ভাইবোন’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘সাধু শয়তান’, ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’, ‘মায়ার বাঁধন’, ‘গুণ্ডা’, ‘আগুন’, ‘মতিমহল’, ‘অমর প্রেম’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘বন্ধু’, ‘কাপুরুষ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সখি তুমি কার’, ‘নাগিন’, ‘আনারকলি’, ‘লাইলী মজনু’, ‘লালু ভুলু’, ‘স্বাক্ষর’, ‘জজসাহেব’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘দেবর ভাবী’, ‘রাম রহিম জন’, ‘আদরের বোন’, ‘দরবার’, ‘সতীনের সংসার’ প্রভৃতি।