মহসীন শেখ :

পর্যটন মোটেল লাবনী। অপরাধী এবং অপরাধের স্বর্গ রাজ্যের নাম। হোটেলটিতে ভোর থেকে সারারাত পর্যন্ত দেহ ব্যবসায়ী, নারী, জেলার শীর্ষ ব্ল্যাক মেইলিং চক্র, মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নারী-পূরুষ সদস্য এবং জুঁয়াড়ীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়। এছাড়াও হোটেলটির বিভিন্ন কক্ষে সূর্য ডুবার পর থেকেই শহর ও শহরতলী ছাড়াও জেলার বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ থেকে অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করা চিহ্নিত দেহ ব্যবসায়ী নারী এবং বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের মেয়েদের নিয়ে শুরু হয় “জলসা” অনুষ্ঠান। নামে জলসা হলেও প্রকৃত পক্ষে সেখানে মদ পান ও দেহ ভোগ সহ মনোরঞ্জন অনুষ্ঠান।

তথ্যমতে, ওই হোটেলের রেস্তোরাতেও সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি দখলে থাকত চিহ্নিত প্রকারক চক্র ও দেহ ব্যবসায়ী নারী-পূরুষের হাতে। বিভিন্ন সময় অনেক অভিজাত পরিবারের সন্তানদের ফাঁদে ফেলে হোটেল কক্ষে নিয়ে বিয়ে না করলে প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়ার হুমকী দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন অপরাধের পাশাপাশি হোটেলের দক্ষিনাংশে একটি কক্ষে শুরু নিয়মিত চলত মদ ও জুঁয়ার আসর। সেখানে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই অবস্থান করতো। সেখানের অভিজাত পরিবারের কন্যা এবং পূত্রবধুরা আনাগোনা করতো বলে তথ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারের শীর্ষ তালিকাভূক্ত কয়েকজন মাদক সম্রাট তাদের সিন্ডিকেটে থাকা নারী সহ অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হতো বলেও প্রশাসন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। স্বনামধন্য পর্যটন কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরেই অপরাধের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং বিস্বস্থ সূত্রের। এসব অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

অপরাধী ওই সিন্ডিকেটের সক্রিয় কয়েকজন নারী সদস্য রোকসানা, ইয়াসমিন, রাশু, রাজু, বেবি, খালেদা আক্তার, আফরোজা, তসলিমা, ডলি, মনোয়ারা, জলসা ও প্রিয়ংকা সহ আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে কৌশলে তাদের অপকর্মের গুরুত্ব বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, মোটেল লাবনীর ইজারাদারের পক্ষে দায়িত্বে থাকা রাশেদুল হক সকল প্রকার অপরাধ ও সার্বিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাশেদ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় কক্সবাজার শহর ছাড়াও জেলার শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বশ করে রেখেছে। যার কারণে ওই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ অব্যাহত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো ছিলোনা বলেও দাবি একই সূত্রের।

অভিযোগ রয়েছে, মেসার্স বেস্ট ইস্টার্ণ নামের ঢাকার এ প্রতিষ্ঠানটি পর্যটন কর্পোরেশনের কাছ থেকে মোটেল লাবণী ইজারা নেয়ার পর থেকে ঢাকা-গাজীপুর ও কক্সবাজার কেন্দ্রিক শক্তিশালী একটি অপরাধী সিন্ডিকেট এ হোটেলটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। প্রতিদিন জলসার আসরের নামে পর্যটন কর্পোরেশনের এ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেন হতো কোটি কোটি টাকার ইয়াবা। সেই সিন্ডিকেটে ছিলো নারী সদস্যরাও। আইন-শৃংখলা বাহিনীর কতিপয় দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম চালানো হতো বলে একাধিক বিশ্বস্থ সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওসব অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তির কাছ থেকেও ওসব অপকর্মের তথ্য কৌশলে জানা গেছে।
সূত্রের দাবি, ওই প্রতিষ্ঠানে থাকা সকল সিসি ক্যামেরায় সংরক্ষিত সকল ফুটেজ খতিয়ে দেখলে অব্যাহত অপরাধের সকল তথ্য বেরিয়ে আসবে।

প্রাপ্ত অভিযোগে প্রকাশ, প্রভাবশালীদের বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজের কব্জায় নিয়ে এসে প্রভাবশালীদের সাথে আতাত করে হোটেল কেন্দ্রীক অপরাধ সংগঠিত করে আসছিলেন ইজারাদারদে পক্ষে দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা রাশেদুল হক খাঁন। দীর্ঘ সময় ধরে অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক অবস্থানে থাকলেও পর্যটনের সাথে চুক্তি ভঙ্গের পাশাপাশি নানা খাতে প্রায় চার কোটি টাকা বকেয়া রাখা হয় বলে জানিয়েছেন পর্যটন কর্তৃপক্ষ। এনিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে লিখিত এবং মৌখিকভাবে একাধিকবার অবগত করা হলেও তা ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তা মোটেও তোয়াক্কা না করা গতকাল বৃহষ্পতিবার(১৭ আগষ্ট) পর্যটন কর্পোরেশন হোটেলটি জেলা প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহযোগীতায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করেছে। অভিযানের নেতৃত্বদেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সাইফুল ইসলাম। এসময় পর্যটন কর্পোরেশনের পক্ষে ছিলেন, পর্যটন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক(প্রশাসন) এস এম হুমায়ুন কবির সরকার, হোটেল শৈবালের ব্যবস্থাপক শ্রীজন বিকাশ বড়–য়াসহ একাধিক কর্মকর্তা।

তবে উল্লেখিত সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন, ইজাদারদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দায়িত্বে থাকা রাশেদুল হক খাঁন। তিনি বলেন, ১৫ বছরের জন্য পর্যটন মোটেল লাবনী ইজারা নেন রাজধানীর স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেস্ট ইস্টার্ণ। কিন্তু সময় শেষ না হওয়ার পূর্বেই নানাভাবে ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিজেদের কব্জায় নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। এনিয়ে ইজাদারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেস্ট ইস্টার্ণ এর পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। বর্তমানে মামলাটি চলমানাধীন থাকলেও তা অমান্য করে জোর পূর্বক হোটেলটি কেড়ে নেওয়া হয়। তবে মামলার রায় পক্ষে আসলে পূণরায় হস্তান্তর করা হবে বলে পর্যটনের পক্ষ থেকে ইজারাদকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

পর্যটন কর্পোরেশনের কক্সবাজারের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হোটেল শৈবালের ব্যবস্থাপক শ্রীজন বিকাশ বড়–য়া জানান, মোটেল লাবণী ১৫ বছরের জন্য ২০০৪ সালে মেসার্স বেস্ট ইস্টার্ণ নামের ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান পর্যটন কর্পোরেশনের কাছ থেকে ইজারা নেয়। বার্ষিক ৫% বৃদ্ধিতে মাসিক ৫৪ হাজার টাকা করে ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ইজারাদার ইজারার কিস্তি পরিশোধ করলেও গত তিন বছর ধরে কিস্তির টাকা পরিশোধ করেনি। এমনকি সরকারী ভ্যাট, ভুমি উন্নয়ন কর,বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় চার কোটি লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। তারমধ্যে ইজারার কিস্তি বাবদ ৩ লাখ ৬৭,৮৬৮ টাকা, বিদ্যুৎ বিল প্রায় ২৫ লাখ টাকা, ভুমি উন্নয়ন কর ৬ লাখ টাকা, টেলিফোন বিল ৩ লাখ টাকা। এছাড়া সরকারী কোন ভ্যাট গত তিন বছরে এক টাকাও পরিশোধ করেনি ইজারাদার মেসার্স বেস্ট ইস্টার্ণ।
পর্যটনের এ কর্মকর্তা বলেন, এসব বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য একাধিকবার নোটিশও দেয়া হয়েছে পর্যটন কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। কিন্তু ইজারাদার এ বিষয়ে কোন গুরুত্বও দেয়নি। তিনি আরো বলেন, ইজারাদাররা বৈধ অবৈধ সকল পন্থায় অর্থ আয় করেছে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করে।

অভিযানের নেতৃত্বদানকারী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সাইফুল ইসলাম বলেন, পর্যটন কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মোটেল লাবণী ইজারাদারের কাছ থেকে দখলমুক্ত করা হয়েছে।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি রনজিত বড়–য়া বলেন, জেলা প্রশাসন, পর্যটন কর্পোরেশ ও আইন-শৃংখলাবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে পর্যটন কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মোটেল লাবণী ইজারাদারের কাছ থেকে দখলমুক্ত করেছে। ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটিতে কোন প্রকার অপকর্ম সংগঠিত না হয় সেদিকে পুলিশের কঠোর নজরদারী থাকবে।