ওসি রেজাউল আমাকে বললেন ‘ওরা (জেএমবি জঙ্গীরা) আপনার মাথায় বোমা বেঁধে রিমোট কন্ট্রোলে উড়িয়ে দেবে’

আহমদ গিয়াস :
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট কক্সবাজার জেলা সদরের ৫টি স্পটসহ দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা করে জেএমবি। এই ঘটনার পর পুলিশসহ অন্যান্য প্রশাসনের কাছে চরম আতংকের নাম হয়ে ওঠে জেএমবি। এসব জঙ্গীদের ভয়ে খোদ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও থাকত তটস্থ। তাই উক্ত ঘটনার পর অন্যান্য অপরাধ দমনের কাজ বাদ দিয়ে প্রশাসনের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে জঙ্গী খোঁজা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার অভিযানে কিছু জঙ্গী ধরাও পড়ে। এরপরও দেশের বিভিন্নস্থানে উড়ো চিঠি লিখে হুমকী দেয়া এবং বোমা হামলা বন্ধ হয়নি। জঙ্গীদের ভয়ে প্রশাসনে এক প্রকার অচলাবস্থা তৈরী হয়। বিষয়টি আমাকে খুব ব্যথিত করে। তাই গোপনে আমিও শুরু করি জঙ্গী খোঁজা। প্রায় আড়াই মাস ধরে অনুসন্ধানের পর ‘মোহাম্মদ’ নামের এক জঙ্গীর খোঁজ পাই আমি, যার বাড়ি কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলে হলেও থাকত চট্টগ্রাম শহরে। বিষয়টি আমি সন্ত্রাস দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা কর্ণেল ফরিদকে অবহিত করি আমি। তিনি ‘মোহাম্মদ’ নামের ওই জঙ্গীটিকে চট্টগ্রামের ‘বিভাগীয় কমান্ডার’ বলে জানান আমাকে এবং তার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে বলেন। এসময় বিষয়টি আমি কক্সবাজার ডিজিএফআই’র তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্ণেল আশফাক এবং উপ-অধিনায়ক মেজর রাকিবকেও অবহিত করি। পরে আমি জানতে পারি ‘মোহাম্মদ’ নামের জঙ্গীটি আসলে খুরুশকুলের জাভেদ ইকবাল। থাকে চট্টগ্রাম শহরে। তাদের প্রধান আস্তানা গরীবউল্লাহ শাহ’র মাজারের পাশ্ববর্তী গলিতে। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে এবং দৈনিক কক্সবাজারে এ বিষয়ে আমি রিপোর্ট করি। আজাদীতে শেষ পৃষ্ঠায় মাত্র এক কলাম জুড়ে রিপোর্টটি ছাপা হয়। এরপর আজাদীতে হুমকী দিয়ে উড়ো চিঠি আসে। সেখানে স্থাপন করা হয় সিসিটিভি। এই রিপোর্টের এক সপ্তাহ পর প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলাম জুড়ে রিপোর্টটি ছাপা হয়। হেডলাইন করা হয়- ‘জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ডার খুরুশকুলের জাভেদ ইকবাল!’ শিরোনামে। এদিকে আমার রিপোর্টটি ছাপা হওয়ার পর অনেকের মাঝে আমার জীবনহানীর শংকা তৈরী হয়। তখন আমি থাকতাম শহরের বদরমোকামে ভাড়া বাসা নিয়ে। আমার সাথে আরো কয়েকজন থাকতেন, এরমধ্যে একজন ছিলেন নিরিবিলির একাউন্টেন্ট সুজন বড়–য়া। একদিন তার কাছে হুজুর টাইপের একজন লোক (যিনি ছিলেন নিরিবিলির স্টাফ) কাজে আসছিলেন। আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন ‘আকবর’ নামের একজন পুলিশ সদস্য। তিনি দাঁড়ি-টুপিওয়ালা লোকটিকে মনে করলেন জেএমবির কোন জঙ্গী বলে। অস্ত্র তাক করে বললেন- হ্যান্ডস আপ। বিষয়টি জানার জন্য আমরা বাইরে এসে দেখে সেই কি হাসাহাসি। কিন্তু আমরা যতই হাসাহাসি করি না কেন, জেএমবি তখন অনেকের মনে চরম আতংক তৈরী করেছিল।
আরেকদিনের ঘটনা- অফিস শেষে গভীর রাতে বাসায় ফিরছিলাম। আমি তখন প্রধান সড়কের থানার রাস্তার মাথায়। আমার অদূরে সাংবাদিক আবদুল মাবুদ (খুনিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান) ও তার খালাত ভাই সাংবাদিক আনোয়ার। আমার একই গলিতে অন্য বাসায় থাকতেন তারা। তাই থামার জন্য ডাক দিলাম তাদেরকে। কিন্তু মনে হল আমার ডাক যত জোরালো হয় তত জোরে তারা সামনের দিকে হাটছেন। এক পর্যায়ে গলির ভেতরে আমার বাসার সামনে তারা থামলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন- ‘ভাইজান, মাইন্ড করেছেন নাকী? আসলে আমরা জেএমবির ভয়ে আতংকিত। আপনিতো তাদের টার্গেট! কিন্তু ভুলক্রমে আপনি মনে করে আমাদের উপর যেন হামলা না হয়!’ মাবুদ এবং আনোয়ারের তৎকালীন শারীরিক কাঠামোর সাথে আমার নাকী সাদৃশ্য ছিল। এ কারণে ভুলে যদি তারা হামলার শিকার হয়! প্রথমে আমি তাদের কথা শুনে রসিকতা বলে মনে করেছি। পরে তারা আরো জানান, মাস পূর্ণ হতে অর্ধেকের বেশি সময় বাকী থাকলেও তারা বদর মোকামের বাসাটি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরীর ঝাউতলার বাসায় ওঠতে যাচ্ছেন। তখনও বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যিই তারা আধা মাসেই বাসাটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এদিকে আমার রিপোর্টের পর জেলা পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। তাদের দুটি শাখা বিষয়টি তদন্ত করে আমার রিপোর্টটি ভূয়া বলে মন্তব্য করে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিষয়টি আমাকে নিশ্চিত করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার গোলাম রসুল। তিনি ৬ ডিসেম্বর ফোন করে আমাকে জানান- ‘গিয়াস সাহেব, আপনার রিপোর্টের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি’। একই মন্তব্য করেন গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা। আমার বন্ধু সাংবাদিক মঈনুল হাসান পলাশ একদিন আমাকে প্রশ্ন করেন- ‘গিয়াস, জেএমবি নিয়ে তুই নাকী ভুল রিপোর্ট করেছিস?’ আমি জানতে চাইলাম তাকে এ কথা কে বলেছে। উত্তরে পলাশ আমাকে জানান, র‌্যাংগ্স এর কুতুবকে (বর্তমানে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী রেজিস্ট্রার) ডিজিএফআই’র একজন এসএসআই নাকী এ কথা বলেছে। আমি পলাশকে বললাম- ‘ওই ডিজিএফআই’র এসএসআই তার পথে চলুক, আমি আমার পথে চলছি। ভবিষ্যতই বলে দেবে কে সঠিক।’ অবশেষে ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী থেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় বিভাগীয় কমান্ডার জাভেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদ। এরপরদিন সকালে আমি এসপি গোলাম রসুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম- আমার রিপোর্টের সত্যতা পেয়েছেন কি? উত্তরে তিনি বললেন- ‘তাইতো জানলাম’। মনে হল তিনি নাখোশ হয়েছেন। অবশ্য ‘মোহাম্মদ’কে আটক করার পর ডিজিএফআই ও র‌্যাব খুশিই বলে মনে হল। ঢাকার সন্ত্রাস দমন বিভাগ, র‌্যাব ও ডিজিএফআই’র পক্ষ থেকে আমার কাছে অভিনন্দন আসতে থাকল। ডিজিএফআই’র কর্ণেল আশফাক আমাকে ‘দেশের মূল্যবান সম্পদ’ বলে অভিহিত করলেন। মেজর রাকিব আমাকে একটি ৩শ টাকার মোবাইল কার্ড দিলেন ‘পুরস্কার’ হিসাবে। যদিও জেএমবির ওই বিভাগীয় কমান্ডারের খোঁজে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আমার খরচ হয়েছিল ২ হাজার ৩শ টাকার বেশি। ওই খরচ আমি পত্রিকা থেকেও নিইনি। কারণ এত টাকার খরচ দেখাবো কী করে?
‘মোহাম্মদ’কে গ্রেফতারের বিষয়ে সোর্স নিয়ে আমি চট্টগ্রাম শহরে পর্যন্ত গিয়েছি। ১ সেপ্টেম্বর রাতে (ওইদিন সম্ভবত শবে বরাত বা ক্বদরের রাত ছিল) র‌্যাব-৭ এর তৎকালীন উপ অধিনায়ক মেজর মুনির ও ক্যাপ্টেন রব্বানীকে নিয়ে আমি জেএমবির বিভিন্ন আস্তানায় গিয়েছি। পরে তারা সোর্স লাগিয়ে শহর থেকে বেশ কয়েকজন জেএমবি ক্যাডারকে গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে একজন জঙ্গী গরীবউল্লাহ শাহ’র মাজারের গেইটের কাছে দোকান খুলে মাজারে বোমা হামলার জন্য উৎপেতে ছিল। পরে র‌্যাব বিভাগীয় কমান্ডার জাভেদ ইকবালকে গ্রেফতার করে। ১৪ ডিসেম্বর দেশের টিভি স্টেশনগুলো এ খবর ফলাও করে প্রচার করে। স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় আমি ছিলাম খুব খুশি। ওইদিন রাতে কি কাজে জানি আমি সদর থানার ওসির কক্ষে গিয়েছিলাম। তখন ওসি ছিলেন রেজাউল করিম। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন- ‘আজকে আপনি কেন এত খুশি, তা আমি জানি। কিন্তু ওরা (জেএমবি জঙ্গীরা) রাতের বেলায় আপনাকে অপহরণ করে কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাবে আর বীচে নিয়ে গিয়ে আপনার মাথায় বোমা বেঁধে রিমোট কন্ট্রোলে উড়িয়ে দেবে আপনাকে’। ওসির কথা শুনে আমি হাসি, তবে তা ছিল তাচ্ছিল্যের। কারণ ওসি হয়ত: জানেন না জেএমবির জঙ্গীদের আমি ভয় পাই না। আমি বিশ্বাস করি, ‘মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসবে, তখন এক মুহুর্তও আগ-পিছ করা হবে না।’ তবে আমাকে মারার চেষ্টা কম হয়নি। একদিন র‌্যাবের হাতে কক্সবাজার থেকে দুইজন জেএমবি জঙ্গী ধরা পড়ে। তারা ছিল কক্সবাজারের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার। তারা আমি যেখানে কর্মরত অর্থাৎ দৈনিক কক্সবাজারের ছদ্মবেশী হকারও ছিল। তখন র‌্যাবের স্টাফ অফিসার ছিলেন এএসপি (বর্তমানে এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) ওসমান গণি। তার সাথে আমার খুব হৃদ্যয়তা ছিল। তিনি আমাকে বললেন- ‘আল্লাহ আপনাদের বাঁচিয়েছেন’। সত্যিই আল্লাহ বাঁচিয়েছেন বলে এক যুগ পরে ওইদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ লিখতে পারছি। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।
চলবে…..