বিশেষ সংবাদদাতা:
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতের পর দেশের মানুষ ছিল নির্বাক। তাঁর স্মরণে মেজবান বা ফাতেহা দেয়ার কারো সাহস ছিলনা দেশের কোথাও। সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও ১৯৭৭ সালে সর্ব প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্মরণে ফাতেহা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কক্সবাজারের রামুতে। আর এই আয়োজনটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু পাগল হাজী হাবিব আহমদ, সৈয়দ আলম ও বঙ্কিম চন্দ্রসহ আরো কয়েকজন মিলে। যারা সেদিনের কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ফাতেহার সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের কোন মূল্যায়ন না হলেও আক্ষেপ নেই তাদের। প্রিয় নেতাকে স্মরণ করতে পেরেছিলেন- এতেই তাদের আনন্দ।
বঙ্গবন্ধুর ৪২তম শাহাদত বার্ষিকীর প্রাক্ষালে গতকাল স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রামুর বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও ব্যবসায়ী ৮০ উর্ধব (তৎকালীন জেল ফেরত) হাজী হাবিব আহমদ এই কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, সেদিন দু’টি গরু, দু’টি খাসি জবাই করে ৫হাজার মানুষ তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর ভয় ও চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর জিয়াফতে যোগ দিয়েছিলেন।
হাজী হাবিব আহমদ জানান, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ১৫ আগষ্ট তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দলের কোন নেতাকর্মী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার কোন খোঁজখবর রাখেনি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী তাঁদের পাশে এসে দাড়াঁনোর কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই স্মৃতিচারণ শুনে সেই পুরানো দিনের ১৯৭৭ সালের মেজবান এর কথা তাঁর মনে পড়ে বলে জানান। দেশের কোন মানুষ তখন বঙ্গবন্ধুর স্মরণে কিছু করতে না পারলেও সেদিন রামুবাসী সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর ফাতেহা দিয়ে।
১৯৭৭ সাল ১২ আগষ্ট রামু খিজারী হাই স্কুলের বারান্দায় বসে বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক (নিজে) জেল ফেরত হাজী হাবিব আহমদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ছৈয়দ আলম, প্রয়াত বঙ্কিম চন্দ্র, সুমল বড়–য়া ও চিত্ত বড়–য়া মিলে বঙ্গবন্ধুর জিয়াফতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। জিয়াফতের জন্য হাজী হাবিব আহমদ চাউল ও সুমল বড়–য়া, চিত্ত বড়–য়া, বঙ্কিম বড়–য়া রান্নার যাবতীয় আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র দেবার সিদ্ধান্ত হয়।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি এত নাজুক ছিল যে, ১৩ আগষ্ট রামু ফকিরা বাজারে বঙ্গবন্ধুর ফাতেহার জন্য গরু কিনতে গিয়ে গরু ব্যবসায়ীরা গরু বিক্রি করতে রাজি হয়নি। গরু ব্যবসায়ী কাসেম ও বদরুজ্জামান এর কাছ থেকে তৎকালীন ২হাজার ৪০০ টাকায় ক্রয় করতে গিয়েও তা বঙ্গবন্ধুর জিয়াফতের জন্য শুনে গরু বিক্রি করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল। পরের দিন আরো ২০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে তাদের অভয় দিয়ে সেই গরু কিনতে হয়েছিল। ওই গরুটির দাম পরিশোধ করেছিলেন (মরহুম) ছৈয়দ আলম।
পরের দিন তৎকালীন এমপি (মরহুম) ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী এই খবর জেনে তিনি নিজে আরো একটি গরু দিয়ে প্রিয় নেতার ফাতেহায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে জানান হাবিব আহমদ।
সেদিন ১৯৭৭ সালের ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধুর জিয়াফতের গোস্ত রান্না করার বাবুর্চি না পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জনৈক বাবুর্চি ও সুবহান মেম্বার এর নেতৃত্বে রান্নার সকল কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু আজ দলে সুবিধা ভোগেিদর কোন অভাব নেই বলে জানিয়ে তিনি বলেন, দুটি গরু রান্না করার পর বঙ্গবন্ধু প্রেমিক কে বা কারা দুটি বড় বড় খাসি পাঠিয়েছিলেন ফাতেহায়। এছাড়াও বহু মুরগী এবং কবুতর পঠিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রেমিকেরা সেদিন ফাতেহায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে জানান হাজী হাবিব। পার্শ্ববর্তী পশ্বিম মেরংলোয়া ক্যায়াং থেকে তৎকালীন বড় ভান্তে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভান্তে সত্যপ্রিয় মহাতের তিন চার শত প্লেট দিয়ে জিয়াফতের খাবার পরিবেশনায় সহযোগিতা করেছিলেন।
তৎকালীন এমপি ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের মহকুমা শাখার সভাপতি আবছার কামাল চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতারা রামু গিয়ে জিয়াফতে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানাজায়। সেদিন পাঁচ সহ¯্রাধিক মানুষ তৎকালীন শাসক শ্রেণীর চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে জিয়াফতে যোগ দিলেও গরু বিক্রেতাগণ জিয়াফতের জন্য গুরু বিক্রি তৎকালীন শাসক দলের রোষানলে পড়ার ভয়ে নাকি আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল।
সেই দিনের রামুবাসীর সাহসী উদ্যোগে সর্বপ্রথম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জিয়াফতের যে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তা আজ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সারা দেশে হাজার হাজার গরু-ছাগল জবাই করে বঙ্গবন্ধুর জিয়াফত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৭৭ সালে ১৫ আগষ্ট রামুবাসী বঙ্গবন্ধুর নামে জিয়াফত দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে ধন্য করেছেন এবং নিজেরাও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৯৭৭ সালে সামরিক শাসনের মধ্যে সর্ব প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জিয়াফত রামুবাসী শুরু করেছিল। যাহা আজ সারা দেশে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে ব্যাপক আকারে পালিত হচ্ছে। তবে সেদিন কঠিন সময়ে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারা যেন আজ ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
হাজী হাবিব আহমদের জামাই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এড. মোঃ নুরুচ্ছবিহ জানান, ১৯৭৭ সালে ১৫ আগষ্ট রামুর কিছু বঙ্গবন্ধু ভক্ত শাসক গোষ্ঠীর চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর নামে জিয়াফত দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে ধন্য করেছিলেন তারা আজ ইতিহাস ও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের মূল্যায়নের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করেন।