মালেকা বেগম

আজ থেকে তিন দশকের বেশি সময় আগে—১৯৮৫ সালে গিয়েছিলাম ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে; আজকের বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। এই দীর্ঘ সময়ে সমাজে-রাষ্ট্রে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। যত দিন যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হচ্ছে। ইতিহাস তাঁর অবিসংবাদী নেতৃত্বের মূল্যায়ন করছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতকেরা দেশের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করতে চেয়েছিল; নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল দেশকে। ঘাতকদের সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।

আমি তখন সচিত্র সন্ধানীতে কর্মরত। কেমন ছিল বাবা আর কন্যার একান্ত সম্পর্ক, ১৫ আগস্টের ঘটনার পর কেমন ছিল তাঁর মানসিক অবস্থা—এসব বিষয় তখন জানতে চেয়েছিলাম শেখ হাসিনার কাছে। আবেগাপ্লুত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি যা বলেছিলেন, তা উঠে এসেছিল সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর পাতায়। আলাপচারিতা-ভিত্তিক সেই সময়ের লেখাটি প্রথম আলোর পাঠকদের কাছে প্রায় হুবহু তুলে ধরলাম:

শেখ হাসিনার গলার স্বর মুহূর্তে কান্নাভেজা হয়ে গেল। বাবাকে হত্যার বিষয়টি তাঁর কাছে কতটা মর্মস্পর্শী বেদনাদায়ক, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? ১০ বছর আগে, ১৫ আগস্টেরও আগে শেখ হাসিনা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন; ছেলেমেয়েসহ বিদেশে চাকরিরত স্বামীর কাছে যাবেন বলে। কে জানত সেই বিদায়ই শেষ বিদায়?
সে ঘটনার কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা মুহূর্তে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। এ তো প্রতিদিনের যন্ত্রণা। তিনি বাবার গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। রাজনৈতিক হাজারো টানাপোড়েনের মধ্যে, কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও বাবার হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা তাঁকে আজও বাক্‌রুদ্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তিনি বলতে থাকেন:
শুধু বাবার চেহারাটা মনে হয়, ভাবি, যার জন্য দেশ স্বাধীন হলো, তাঁকে এভাবে হত্যা করা হলো! আর করল এ দেশেরই কিছু কাপুরুষ? আর কখন করল? যখন স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে, দেশে পুনর্গঠনের কাজ চলছে, তখন। স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার সময় এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তাঁর জীবন বিপন্ন ছিল—শত্রুর হাতে ছিলেন বন্দী, কিন্তু তখনো তাঁকে হত্যা করতে সাহস পায়নি ঘাতকেরা। অথচ যে সময় তিনি দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে শুরু করেছিলেন, সে সময়ই তাঁকে ঘাতকেরা হত্যা করল। আমি তখন বেলজিয়ামে ছিলাম। হঠাৎ সকালে খবর পেলাম, বাংলাদেশে ‘ক্যু’ হয়েছে। মনে হয়েছিল, বাংলাদেশে ‘ক্যু’ হয়ে থাকলে আমার আর কেউ নেই। আমি হতচেতন হয়ে পড়ি। তখনো পুরো খবর পাইনি। খবর পাওয়ার পর আমি কী অবস্থায় ছিলাম, তা আর আমি বলতে পারি না। কোনোভাবেই আমি এই হত্যাকাণ্ডকে সহ্য করতে পারিনি। এখনো তা একই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনা বাবার কাছাকাছি ছিলেন, বাবা-মা-ভাইবোনের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, এমন কিছু কি তিনি জেনেছিলেন? তাঁর বাবাকে কি বিচলিত হতে দেখেছিলেন সে সময়?
শেখ হাসিনা তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, না তো। তেমন তো কোনো ঘটনাই ঘটেনি, কোনো আভাসও শুনিনি যে এত বড় আঘাত নেমে আসতে পারে পুরো পরিবারের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি চলছিল বাবাকে সংবর্ধনা দেওয়ার। সেটা ছিল বরং সুন্দর আনন্দের সময়। তবে কি জানেন, বাবা সব সময় আঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। বলতেন, ‘গরিব-দুঃখীর ভাত-কাপড়ের যাঁরা ব্যবস্থা করেছেন, তাঁরাই নিহত হয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির অনেক আছে।’ স্বাধীনতার পর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি জানি, চিলির আলেন্দের মতো আমাকে হত্যা করা হতে পারে, কিন্তু তাতে আমি ভীত নই।’ সে রকমই তো হলো শেষ পর্যন্ত।
ভয়ভীতির কাছে কোনো দিন বাবা মাথা নত করেননি। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই উনি জানতেন, জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই রাজনীতি করতে হয়। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা তাঁর কাছে ঘৃণাজনক ছিল।
যে মুহূর্তে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিলেন, দেশের মানুষের জন্য সুন্দর জীবন গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন যখন, তখনই নেমে এল তাঁর ওপর আঘাত।
বিদেশেই ছিলাম ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত। অনেকে অনেকভাবে বাবার হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে। কাগজে দেখেছি, গণতন্ত্রের জন্য, জিনিসের দাম কমানোর দাবিতেই নাকি আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা নিছক একটা অজুহাত ছিল। পার্লামেন্টের তখন সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল। স্বাধীনতার পর সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তখন চালু ছিল। দেশে ছিল সত্যিকার গণতন্ত্র। আর জিনিসের দাম বাড়ার বিষয়, অভাব-দুর্ভিক্ষের বিষয় যে চক্রান্ত করেই সৃষ্টি করা হয়েছিল, মুজিব সরকারের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করার জন্য, সেটা তো আজ সবারই জানা হয়েছে।
তা ছাড়া এটাও দেশবাসী ভালো করেই জানেন যে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ও সুযোগসন্ধানী কয়েকজন রাজনীতিবিদ একত্রে ষড়যন্ত্র করে এই নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড সমাধা করেছে। ক্ষমতালাভের সহজ পথ হচ্ছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনকে ক্ষমতাচ্যুত করা। মুজিব হত্যার পর এই পথেই তো বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হচ্ছে।
১৫ আগস্ট ৭৫-এ সামরিক অভ্যুত্থান বা ‘ক্যু’ হয়েছিল বলে কথা চলে এসেছে। আসলে এটি ছিল নেহাত ডাকাতি। গোটা জাতির বিরুদ্ধে এটা ছিল একটা ডাকাতি।
আমরা দুই বোন বিদেশে ছিলাম। আমাদের গোটা পরিবারকে হত্যা করা হলো। ক্ষমতা পেল মোশতাক। সে তো রাজনীতিবিদ। সামরিক অভ্যুত্থান হলে রাজনীতিবিদ ক্ষমতা পায় কী করে? ঘোষণা দেওয়া হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্রের কথা বলে অগণতান্ত্রিক পন্থায় এল কেন? এই প্রশ্ন আমার সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সব স্তরের মানুষের কাছে: এখনো কীভাবে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়ে এ দেশে বক্তব্য দেওয়া চলছে, এখনো বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে সমালোচনা চলতে পারে? বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জাতিসত্তার জন্য বাঙালির হয়ে যে ভূমিকা তিনি রেখেছেন, সেই জন্যই তো তাঁকে প্রাণ দিতে হলো—এ বিষয়টি আজ সবার ওপর স্থান দিতে হবে।
শেখ হাসিনার মুখে তখন জ্বলজ্বল করছিল বাবার জন্য গর্ব।
বাঙালির জন্য, বাঙালি জাতিসত্তার জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ভূমিকা জনগণের কাছে নতুন করে বলার কিছুই নেই। তবু শেখ হাসিনার মুখ থেকে তাঁর বাবার এই ভূমিকা বিষয়ে কিছু শুনতে চাইলে তিনি বললেন:
আমার বাবা যখন থেকে রাজনীতিতে জড়িত হন, তখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিলেন পাক শোষণে জর্জরিত। পর্যায়ক্রমে বারবার আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাসের ওপর এসেছে আঘাত, পাক সরকার বারবার সেসব ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল।
আমি দেখেছি, বাবা এসব নিয়ে খুবই ভাবতেন। সেনাবাহিনী, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চতর পড়াশোনা, বিজ্ঞানসাধনা, বিদেশে চাকরি—কোনো ক্ষেত্রেই বাঙালির স্থান ছিল না। খুব কমসংখ্যক, বলা যায়, নামমাত্র দু-একজন সুযোগ পেয়ে যেতেন। বাবা এ নিয়ে বিচলিত হতেন। শুনেছি ৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্র হিসেবে তাঁর যথাযথ ভূমিকাই তিনি রেখেছিলেন।
পরবর্তী পর্যায়ে দেশের সব ক্ষেত্রে যখন বাঙালির ওপর চরম শোষণ নেমে এল, তখন ৬৫-র পর তিনি আওয়ামী লীগ থেকে ৬ দফার আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন।
আমি পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে বাবাকে তখন খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। যদিও আজ থেকে ২০ বছর আগের কথা, তবু মনে হয় স্পষ্ট দেখছি বাবাকে। খাবার টেবিলে যদি আমরা বাবাসহ খেতে বসেছি, কিংবা দুর্লভ সব মুহূর্তে বাবাকে ঘিরে বসে গল্প শুনছি, গল্প করছি, তখন হঠাৎ বাবা বলতেন, এখন চুপ; বলো তো কী আমাদের প্রতিজ্ঞা? আমরা ট্রেনিং-প্রাপ্তের মতো চটপট ছয় আঙুল তুলে বসে থাকতাম। বাবা খুশি হতেন। হ্যাঁ, এই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা। বাবা সংগ্রাম করছেন ছয় দফার জন্য, অতএব আমরাও তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই সংগ্রামে শরিক থেকেছি। স্বাধীনতাসংগ্রামের শুরুতে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাবা খাবার টেবিলে আমাদের সঙ্গে যখন খেতে বসতেন বা কথা বলতেন, তখন ছয় আঙুল তুলেই পাঁচ আঙুল সরিয়ে নিতেন, বলতেন, এখন শুধু এক দফা।
এরপর নতুন মোড় নিল সংগ্রাম। ছয় দফা আন্দোলন পরিণত হলো ১১ দফা আন্দোলনে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বাবাকে অভিযুক্ত করা হলো। বন্দী করা হলো। সঙ্গে আরও অনেককে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যায়। আমরা জানতে পারিনি। ছয়-সাত মাস বাবার কোনো খোঁজই পাইনি। সে সময় আমরা যথেষ্ট কষ্ট ও দুর্ভোগের মধ্যে কাটিয়েছি কিন্তু এক দিনের জন্যও যে ভেঙে পড়িনি, সে জন্য আমার মায়ের দৃঢ়চেতা ভূমিকাই ছিল প্রধান।
বাবাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠকে বসানোর চেষ্টা চলছিল তখন। আমার মনে আছে, তখন বাবার কিছু কিছু সহযোগী চেয়েছিলেন এই বৈঠক হোক। কিন্তু আমরা জানতাম, জনতা বাবার ওপর ভরসা করে আছে। আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠকে বসে স্বাধীনতার দাবি পূরণ করা যাবে না। সেই মুহূর্তে বাবা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। এ নিয়ে তখন নানা তর্ক-বিতর্ক চলছিল। সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়েছিল। অনেকে ভাবছিলেন, পাক সরকার বাবাকেও মেরে ফেলবে। তার চাইতে আলোচনার প্রস্তাবে রাজি হওয়া ভালো।
আমরা অত্যন্ত বিরোধিতা করেছিলাম। মা বাবাকে বলে পাঠিয়েছিলেন, তিনি যেন প্যারোলে মুক্তি মেনে নিয়ে বৈঠকে না বসেন। এমনও বলেছিলেন যে তুমি জান না বাইরের জনতা, দেশবাসী তোমার নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা করছেন, দেশে এখন এমন আন্দোলন চলছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খান এখন আপসের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ হতে পারে না। বৈঠকে বসে তুমি জনগণের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করতে পারো না। যদি তুমি বৈঠকে যাও, তবে আমি পল্টন ময়দানে তোমার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেব।’
মনে আছে, বাবা এ কথা শুনে প্রাণ খুলে হা হা করে হেসে উঠেছিলেন। বলছিলেন, ‘তাহলে তো ভালোই হয়।’ আমার মা ছিলেন পর্দানশিন। কখনো বাইরের সভা, জনসভায় যেতেন না। পরিচিত লোক ছাড়া কারও সামনে বের হতেন না। বাবা চাইতেন, তিনিও তাঁর সঙ্গে কাজ করুন। কিন্তু সেটা সম্ভব হতো না। তাই বাবা হেসেছিলেন, মা কতটা বিচলিত হয়েছিলেন যে পল্টনে বক্তৃতার কথা তুলেছিলেন, সেটা বাবা উপলব্ধি করেছিলেন। এ ঘটনার পর বাবা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন যে প্যারোলে মুক্তি তিনি নেবেন না, বৈঠকে তিনি যাবেন না।
আমার মনে আছে, দুজন রাজনীতিবিদ আইনজীবী আমাকে খুবই আক্রমণ করে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কেমন মেয়ে, চাও না যে বাবা বেরিয়ে আসুক বন্দিশালা থেকে?’ এ কথা শুনে খুবই খারাপ লেগেছে। কোন সন্তান না চায় বাবাকে কাছে পেতে? কিন্তু বাবা যখন কষ্ট করছেন দেশের ও দশের জন্য, তাঁর অভাবে যখন আমাদের মন বিদীর্ণ, কিন্তু তবু বাবা যেন বৃহত্তর সংগ্রামে জয়ী হতে পারেন, সে জন্য আমরাও মন শক্ত করতে প্রস্তুত হচ্ছিলাম, ক্ষুদ্র সাংসারিক বেদনার ঊর্ধ্বে বাবাকে রেখেছিলাম—যখন সমগ্র জাতি ও জনগণ আমাদের সমর্থন জানাচ্ছিল, তখন এই ধরনের ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মহলের কথা শুনে আমি খুব কেঁদেছিলাম।
শেখ হাসিনা সেদিনের কথা মনে করে যেভাবে ভাবাপ্লুত হয়ে ওঠেন, তা খুবই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু আমার জন্য ছিল খুবই বেদনাদায়ক। এমন একটি বিষয়ে তাঁকে এ সময় আলোড়িত করা কি ঠিক হচ্ছে? তিনি আমার ইতস্তত ভাব দেখে, বেকায়দা অবস্থা দেখে একটু হাসলেন, বললেন, স্মৃতি তো অনেক—স্মৃতি তো পীড়িত করছে সব সময়। বাবাকে পেয়েছি খুব অল্পই—সব সময় রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত, তাঁকে জেল-জুলুম সইতে হয়েছে অনেক, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে। কিন্তু তবু তো আমার এমন কিছু দুর্লভ স্মৃতি বাবাকে জড়িয়ে রয়েছে, যা আমার একান্তই নিজস্ব সম্পদ এবং এমন কিছু স্মৃতি রয়েছে, যা দেশ ও জাতিরও সম্পদ।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। এই বাড়িতেই শেখ হাসিনার বহু স্মৃতি জড়িত। যে ঘরে বসে কথা হচ্ছিল, সে ঘরটিতে একসময় বসতেন তাঁর বাবা। দীর্ঘ ছয় বছর বিদেশে থেকে দেশে ফেরার পর এই বাড়িতে এসে তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, যেভাবে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন, সে কথা আজ মনে পড়ছিল তাঁর। এই বাড়ির সিঁড়িতে এখনো বঙ্গবন্ধুর রক্ত, ওপরের প্রতিটি ঘরে এখনো হত্যার চিহ্ন রয়েছে। ঘরগুলো বন্ধ রয়েছে। তাঁর দীর্ঘশ্বাস ঘরের আবহাওয়াকে আর্দ্র করে তোলে। তিনি বলেন:
বাবা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন, ছেলেমেয়ের প্রতি ছিলেন যথেষ্ট যত্নবান। যদিও তাঁকে আমরা সবাই সংসারের জটিলতার মধ্যে টানিনি কখনো, নিজেরাই সব প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবিলা করেছি, কিন্তু লক্ষ করেছি, বাবা তা টের পেতেন। তাঁর মনে বিরাট করে বাজত আমাদের দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু দেশ ও জাতি তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠুক, আমরা তাঁকে এই প্রেরণা জোগাতাম।
অবসর সময় তাঁর ছিল না মোটেও। তবু যখনই সময় হতো, সেটাই ছিল তাঁর অবসর এবং আমাদের সে সময়টাতেই তাঁর জন্য জেগে থাকতে হতো। আমার বাচ্চাদের সাথে তাঁর হাসিখুশি খেলা ছিল অবসর বিনোদনের একটা অঙ্গ। দুপুরে ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাতে সজাগ রাখতে হতো, বাবা কাজ থেকে ফিরে এসে ওদের সাথে খেলা করবেন, সে জন্য।
আমি যে অত বড় ছিলাম, ছেলেমেয়ের মা তখন, সে সময়ও কথা বলতে বলতে পরখ করতেন হাতের নখ কাটা হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য। না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে রেহাই ছিল না। যত রাতই হোক, বাবা ফিরে এসে ঘুম ভাঙিয়ে নিজের হাতে খাওয়াতেন। আর আমার ভেজা চুলের গোছা নিয়ে নিত্যদিন এক ঘটনা ঘটত। কলেজ থেকে ফিরে ভেজা চুল বাঁধা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে যেতাম সন্ধ্যা হলে। বাবা রাতে এসে তা দেখে চুল খুলে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে আঁচড়ে দিতেন—এমন ঘটনা রোজই ঘটত। আমিও ঘুম ভেঙে গেলেও চুপ করে চোখ বুজে বাবার এই সস্নেহ যত্নটুকু উপভোগ করতাম। এসব খুঁটিনাটি বহু স্মৃতি আমার হৃদয়ে মণিকোঠায় সঞ্চিত আছে। সেসব বলতে গেলে এক বিরাট কাহিনি হয়ে দাঁড়াবে—একদিন প্রকাশ করব নিশ্চয়ই।
তাঁর ব্যক্তিগত এই স্বীকারোক্তিটা, সদিচ্ছাটা যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে নিশ্চয়ই একটা কাজের কাজ হবে। আমরা সে রকমই আশা করব, যেন দ্রুতই শেখ হাসিনা স্মৃতিকথা লেখেন, তাঁর বাবাকে কাছ থেকে দেখা বিষয়ে আলোকপাত করেন।
এই কথার জের টেনেই জানতে চাইলাম, তিনি কি কিছু বলবেন মুজিব হত্যার ১০ বছর পরবর্তী দেশের পরিস্থিতি বিষয়ে?
শেখ হাসিনা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, সবাই তো জানেন বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার পর থেকেই হত্যার রাজনীতির শুরু। স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হওয়া ও পরে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া—এ ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। রাজনীতিবিদদের গালি দিতে দিতে ক্ষমতা দখলের শুরু হয় এবং পরে ক্ষমতাসীনেরাই রাজনীতি করতে শুরু করেন। অথচ সত্যিকার রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করা বন্ধ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করেছে, তাদের বিচার হয়নি আজও। বরং পুরস্কৃত করা হয়েছে। হত্যাকারীদের শেষ আশ্রয়স্থল হয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এই যে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার শুরু, তার জের এখনো চলছে। দিনের পর দিন হত্যা, নির্যাতন, নারী নির্যাতন, অপহরণ, খুন বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের জীবিকা চালানো দুঃসাধ্য।
যে ধারা চলছে এই ১০ বছর ধরে, তাতে দেখা যাচ্ছে, হত্যা করে ক্ষমতায় যাওয়া ও দল গঠন একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। কিছু উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ কিন্তু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একশ্রেণির অপরাধীদের নিয়ে দল গঠনের বিষয়টি সবার চোখের সামনেই করছেন।
রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা না করে অস্ত্র ব্যবহার ও সন্ত্রাস করে রাজনীতির অঙ্গনকে দখলের অপচেষ্টা চলছে।
এই পর্যন্ত বলে তিনি বললেন, রাজনীতিবিদদের জীবনে জনগণের আস্থাই সম্বল। অশুভ শক্তি রাজনীতিবিদদের এই সম্বল ও জনগণের আস্থাকে নষ্ট করার জন্যই তৎপর থাকে।
জানতে চাইলাম, শেখ হাসিনা কি তাঁর জীবনে জনগণের আস্থা বজায় রাখতে পারছেন? তাঁর বাবাকে কেমনভাবে দেখেছেন জনগণের আস্থা অর্জন করতে? তাঁর বাবার কি দুর্নাম ছিল না?
তিনি বললেন, বাবার পথ ধরেই রাজনীতিতে এসেছি। বাবা যে দল গঠন করে গেছেন, সেই সংগঠনেই আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি। বাবা কষ্ট করে দল করে রেখে গেছেন, আমি তৈরি পেয়েছি।
তিনি বললেন, বাবার রাজনৈতিক জীবনে মিথ্যা, দুর্নাম রটেছিল তো বহু। কিন্তু তাঁর সমগ্র জীবনের পুরস্কারপ্রাপ্তির পর্যালোচনা থেকেই তো বোঝা যায়, এই দুর্নাম কতটা ছিল মিথ্যা-বানোয়াট।
আমি যদি জনগণের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য কিছু করি, তবে অশুভ শক্তি আমার নামে মিথ্যা-বানোয়াট বানিয়ে কিছু বলবেই। কিন্তু জনগণকে যদি সত্যিকার ভালোবাসা যায়, তবে জনগণের ভালোবাসাও সত্যি হয়ে ওঠে।
বাবা জনগণকে ভালোবেসেছিলেন, দেশ ও জাতিকে ভালোবেসেছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে—তাই আজ এত বছর পরও দেশবাসী তাঁর হত্যাকাণ্ডের জন্য অশ্রু মোচন করে, শোক করে।
১৫ আগস্টকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী কর্মীদের রক্তদানের কর্মসূচির কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, আমার বাবা রক্ত দিয়েছেন, চরম মূল্য দিয়েছেন দেশ ও জাতির জন্য, আমরা রক্ত দিচ্ছি সেই রক্তাক্ত দিনের কথা স্মরণ করেই—যদি কোনো রুগ্ণ, অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী এই রক্তে জীবন ফিরে পায়, তবেই আমরা হব কৃতার্থ।
শেখ হাসিনা বলতে চেয়েছেন অনেক কথা। কিন্তু সব কথা প্রকাশের ছাড়পত্র নেই। বাবার প্রসঙ্গে বলতে গেলেও তো সেই একই প্রসঙ্গ। রাজনীতি ছাড়া বঙ্গবন্ধুর কোনো সত্তাকে বুঝতে পারা যাবে না, বঙ্গবন্ধুকে শুধু মেয়ের চোখেও যদি দেখতে চাই, সে দেখাতেও তো ঘুরেফিরে বাংলার অমিততেজ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই চোখে পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বাবা হলেও দেশ ও জাতির পিতা ছিলেন, সেটাই তো একমাত্র ও চূড়ান্ত পরিচয়।

মালেকা বেগম: অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা