এম.আর মাহমুদ

কক্সবাজারের প্রকৃত বাসিন্দারা বড় বেকায়দায়। আপদ-বিপদ-মসিবত যেন পিছু ছাড়ছে না। জেলার ৮টি উপজেলার গ্রামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করায় যেন এখানকার বাসিন্দাদের জন্য অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাসপোর্ট তৈরি, ভোটার হওয়া, জন্ম নিবন্ধন করা, সড়ক পথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রাণির শিকার হচ্ছে এখানকার মানুষ। মিয়ানমান সীমান্তবর্তী হওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানেরা অবৈধভাবে এখানে এসে স্থায়ী বাসিন্দাদের মত বসবাস করছে। ফলে রোহিঙ্গা ঠেকাতে গিয়ে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রতিনিয়ত ঠেকছে।

কথা প্রসঙ্গে চকরিয়ার একজন প্রবীণ ব্যক্তি মন্তব্য করতে শোনা গেছে , কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করে এখানকার বাসিন্দারা অপরাধ করেছে। জন্ম নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের এখতিয়ার বহির্ভূত না হলে কেউ সহজে কক্সবাজার জন্মগ্রহণ করত না। এখানকার লোকজন বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করতে গেলে ডিবি পুলিশের শরণাপন্ন হতে হয়। পুলিশ প্রথমেই জানতে চায়, রোহিঙ্গা কিনা? স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সব ধরণের দলিল পত্রাদি দেয়ার পরও দাবী করেন, মোটা অংকের নগদ নারায়ণ। এক্ষেত্রে ডিবি পুলিশের দাবী মোতাবেক টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেয়ার প্রমাণও রয়েছে ভুরি ভুরি। আবার ডিবি পুলিশের দাবী মোতাবেক অর্থ পরিশোধ করলে মিয়ানমারের নাগরিক হলেও পাসপোর্ট পাওয়ার পক্ষে প্রতিবেদন দিতে কৃপণতা করে না। এ যেন কক্সবাজারবাসীর জন্য আপদ।

অপরদিকে ভোটার তালিকাভূক্ত হতে গিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-ফুফু’র এনআইডি ছায়াকপি সত্যায়িত করে জমা দিতে হচ্ছে। এছাড়া বাপ-দাদার মৌরুশী সম্পত্তির খতিয়ান। এখানেই শেষ নয়, ওই খতিয়ানের ছায়াকপি সত্যায়িত করে নিতে হয় সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাছ থেকে। এ পর্যন্ত। কাঠ খড় পুড়িয়ে একজন মানুষের পক্ষে ভোটার হওয়া কি যে বিপদ ভূক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

এতদিন স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে জন্ম নিবন্ধন রেজিষ্ট্রেশন করা গেলেও সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপনে এই প্রথাও জটিল হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে ১-৪৫ দিন বয়সী শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করার ক্ষমতা ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে। আর ৪৬ দিন থেকে ২ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন লাগবে। এর চাইতে বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন অধিদপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। এ নির্দেশনাটি ইতিম্েযধ কক্সবাজার জেলার সব ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছানো হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে জেলাবাসীর জন্য হবে বিপদ।

সূত্র মতে, অসচেতন ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এ যেন আরেকটি মসিবত। যেখানে এখনও অনেক মানুষ ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া উপজেলা পরিষদ চিনে না। তাদের ক্ষেত্রে কি হবে আল্লাহই ভাল জানে। দায়িত্বশীল একটি সূত্র দাবী করেছেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ঠেকাতে সরকার এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ‘এসব যেন ঢিল ছুটানো ছেলেদের জন্য খেলা হলেও ব্যাঙের মরণের মতই।’ নির্বাচন কমিশন রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকাভূক্ত না করার জন্য কঠোরতা অবলম্বন করেছে। রোহিঙ্গা প্রবণ কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, জেলা প্রশাসকদেরকে কঠোর ভাসায় হুশিয়ার করে দিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা ঠেকাতে গিয়ে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা পদে পদে ভূগান্তির শিকার হচ্ছে। বিষয়টি যেন ঠক বাচতে গাঁ উজাড়ের মত। মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত বন্যার পানির মত ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। এসব ইয়াবা জলপথ ও সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কালে-ভাদ্রে ইয়াবার চালান আটক করছে; কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। ইয়াবা পাচার করে যারা রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই এখনও পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। ইয়াবা পাচারে জড়িতদের তালিকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও দেখা যাচ্ছেনা। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ইয়াবার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনেকটা কঠোর। ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদের ইয়াবা পাচার কারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়নে একটি প্রস্তাব চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে পাচার হয়েছে। কি জানি কবে কার্যকর হয়। এদিকে জেলার সব মানুষ ইয়াবা পাচারের সাথে জড়িত নয়। কিন্তু সড়কপথে প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তল্লাশীর নামে অপমানজনক ভাবে হয়রাণির শিকার হচ্ছে। তা ভূক্তভোগীরাই ভালো জানে। সম্প্রতি পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দাবী করেছেন, মাদক ঠেকাতে বিয়ার উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য। যাক! বিয়ার উন্মুক্ত করে ইয়াবা পাচার ঠেকানো গেলে আমাদের দেশের নেশাগ্রস্থ যুব সমাজের জন্য কল্যাণকর হবে। তবে ইয়াবার পাচার ঠেকাতে সব মানুষকে হয়রাণি করার কোন যুক্তি নেই। কক্সবাজারের সব মানুষ যেমন রোহিঙ্গা নয়, তেমনি সবাই ইয়াবা পাচারেও জড়িত নয়। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন প্রবীণ শিক্ষক ছোট একটি গল্পের অবতারণা করেছেন, ‘এক সময় ইছড়ে পাকা এক যুবক বাজারের চা-দোকানে বসে বলতে শুরু করেছে ‘বাজারে যত কালো লোক এসেছে সবাই তার বাবার শ্যালক।’ এ সময় কালো বর্ণের এক ভদ্র লোক তার কথা শুনে রাগান্বিত হয়ে ওই যুবকের গালে দু’টা থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বলল, কালো লোকগুলো সবাই তোর বাবার শ্যালক হয় কেমন করে। থাপ্পরের পর ওই যুবক নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলে বসল সবাই নয়, আমার কালো মামারাই শুধু আমার বাবার শ্যালক। ব্যাপারটি অনেকটা অনুরূপ। কক্সবাজারের বাসিন্দারা কি এ ধরণের কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট আপদ-বিপদ-মসিবত থেকে রক্ষা পাবে না?