ডেস্ক নিউজ:

গত ঈদে মাকে দেখে এসেছি। সেই দেখাই যে শেষ দেখা হবে, তা তো আর জানতাম না। মায়ের মুখটা আবার দেখতে ইচ্ছা করে। আর একটাবার যদি মায়ের মুখটা দেখতে পারতাম! কথাগুলো বাংলা ট্রিবিউনকে বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের আঘাতে দুই চোখ হারানো সিদ্দিকুর রহমান।
ভারতের চেন্নাইয়ে চোখের উন্নত চিকিৎসা শেষ করে শুক্রবার (১১ আগস্ট) বিকালে দেশে ফেরার পর তিনি এসব কথা বলেন। চেন্নাইয়ের চিকিৎসাতেও সিদ্দিকুরের চোখের আলো না ফেরায় মাকে আরেকবার দেখতে না পারার আক্ষেপ রয়েই যাচ্ছে তার। তবে তারপরও তিনি বাঁচতে চান। সিদ্দিকুর বলেন, ‘চোখে আঘাত হওয়ার পর আমি একবারও ভাবিনি আমি আর দেখতে পাবো না। আমি ভাবতাম দুই চোখই ভালো হয়ে যাবে। আঘাত পেয়েছি, রক্ত ঝরেছে— কিন্তু চোখ ভালো হয়ে যাবে, এই আশা ছিল আমার। কিন্তু আমার চোখে তো আর আলো ফিরবে না। তবু আমাকে বাঁচতে হবে, আমি বাঁচবো। আমি ভালোভাবেই বাঁচবো।’
শুক্রবার বিকাল ৪টার দিকে চেন্নাই থেকে দেশে ফেরেন সিদ্দিকুর। বিকাল ৫টার দিকে বিমানবন্দর থেকে বের করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সেখানেই বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় তার।
চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের উন্নত চিকিৎসাতেও কোনও লাভ না হওয়ায় বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত সিদ্দিকুর হাসপাতালের বেডে বসেই কথা বলেন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার তিন জন ভাতিজা-ভাতিজি আছে। ওদেরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ঢাকায় আমার কোনও খারাপ সময় এলেই আমি বাড়িতে গিয়ে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। আমার মন ভালো হয়ে যেত। গত ঈদেও ওদের দেখে এসছি। কিন্তু আর তো দেখতে পারব না।’
কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিদ্দিকুরঢাকায় চিকিৎসা নেওয়া, তারপর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চেন্নাই যাওয়া এবং সেখান থেকে আশাহত হয়ে ফিরে আসা— সবকিছু নিয়েই ধীরে ধীরে, কখনও কান্নাভেজা কণ্ঠে কথা বলেন সিদ্দিকুর। কথা বলতেই বলতেই তার কালো চশমার ভেতর দিয়েও বেরিয়ে আসছিল অশ্রু। তিনি বলেন, ‘এখানকার চিকিৎসকদের কথা শোনার পর চিন্তিত ছিলাম। খারাপ খবরই তো শুনছিলাম সবসময়। পরে চেন্নাই পাঠানোর কথা হলো। তখন একটু আশার বাণী শুনলাম। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো ভালো কিছু হবে। বড় ভাই ছিল, আমার অনেক সেবা করেছেন। কিন্তু কী লাভ হলো! একজীবনেই আল্লাহ দৃষ্টিপূর্ণ ও দৃষ্টিহীন— দুইটি জীবনই দেখিয়ে নিলেন। হয়তো আমার ভাগ্যে এমন কিছুই ছিল।’
সিদ্দিকুর বলেন, ‘চেন্নাইয়ে প্রথম চিকিৎসক দেখে কিছু বলেননি। পরে তিনি লিঙ্গম গোপালকে রেফার করেন। তখন আমার সেন্স কাজ করত না, মাথা কাজ করত না, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।।’ ঘোরটা কী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো আসলে কিছু দেখছি না। কিন্তু কানটা সজাগ ছিল। আসলে কেমন ছিলাম, বলতে পারব না। কিন্তু আমি সবসময় চাচ্ছিলাম, আমি যেন সুস্থ থাকি। আমি দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করতাম। কারণ আমাকে বাঁচতে হবে। আমি বাঁচবো, আমি ভালোভাবেই বাঁচবো।’
লিঙ্গম গোপাল দেখে কী বলেছিলেন জানতে চাইলে সিদ্দিকুর বলেন, ‘‘উনি আসলে বলেছিলেন দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। মিরাকলের আশায় বা মানবিক দিক বিবেচনা করে অস্ত্রোপচার করতে পারি বলে জানান তিনি। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন, আমাকে তারা ফোন দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সিদ্দিক চাইলে তার অপারেশন হবে। সে যেভাবে চাইবে, সেভাবেই হবে।’ পরিচালক স্যারও আমাকে বলেন, ‘অপারেশনটা করেই দেখো, যদি ভালো কিছু ঘটে যায়।’’ তারপরই সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান সিদ্দিকুর।
চেন্নাই থেকে আশাহত হয়ে ফিরে আসার প্রসঙ্গে সিদ্দিকুর বলেন, ‘আমার সান্ত্বনা এটাই যে আমাদের সাত কলেজের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সবার চোখ আছে।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘‘ওদের সাফল্য চাই আমি। ইতিহাসে অনেকের চোখ গেছে, রক্ত গেছে। আমার চোখের বিনিময়ে তাদের যদি কিছু একটা হয়, সেটাই তো আমার জন্য সৌভাগ্য। আমার কোনও কষ্ট নেই। আমি এই সময়ে এসে নিজেকে সফল মনে করি। তারা আমাকে সিদ্দিক ভাই বলে ডাকবে, অনেক বড় কর্মকর্তা হবে। তারা যখন বলবে ‘উনি আমাদের সিদ্দিক ভাই’, তখনই আমার জীবন সার্থক হবে।’’
বিমানবন্দরে অবতরণের পর সিদ্দিকুরএখনকার জীবনটা কেমন— জানতে চাইলে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন সিদ্দিকুর রহমান। পরে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে ফিরতে চাই। যারা আমাকে কাছ থেকে চেনে, জানে; তারা জানে, আমি কারও সাহায্য নিতে পছন্দ করতাম না। এখনও আমি চেষ্টা করব, আমি যেন নিজে চলতে পারি। আমি যেন কারও বিরক্তির কারণ না হই। আমার বাবা মারা গেছেন আমার তিন বছর বয়সে। অনেক সংগ্রাম করে এতদূর এসছি একা একা। পরামর্শ করার মতো কেউ ছিল না। একা একাই সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আর কী বলব!’
ছোটবেলার জন্মান্ধ বন্ধুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার ওই বন্ধুর খোঁজখবর আমি সবসময় নিতাম। এখন যে আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু একটা সময় দেখতাম। এটা আসলে কাউকে বোঝানোর মতো না, তবে আমি দাঁড়াবো, দাঁড়াতে আমাকে হবেই।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী চাকরি দিতে চেয়েছেন জানালে সিদ্দিকুর বলেন, ‘আমি শুনেছি। আমি তো চাই একটা সম্মানজনক অবস্থা। রাষ্ট্র যদি মনে করে একটা চাকরি দেবে, আর যদি ব্রেইল সিস্টেমে সরকার আমাকে লেখাপড়া করার সুযোগ দেয়, তাহলে আমি পড়ালেখা শেষ করতে চাই। আমি মেধার স্বাক্ষর রেখে এসেছি সবখানে। আশা করি, ব্রেইল সিস্টেমে পড়ালেখার সুযোগ পেলে সেখানেও মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারব। সুযোগ পেলে মানুষের জন্যও কাজ করতে চাই। মানুষের অনেক ভালোবাসা আমি পেয়েছি। তাই সারাজীবন মানুষের পাশে থাকতে চাই। রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমাকে যেন অন্ধ বলে হেয় করা না হয়, আমি সেই প্রত্যাশাটুকু রাষ্ট্রের কাছে করি।’
ব্যক্তিগতভাবে কারও প্রতি ক্ষোভ নেই জানিয়ে সিদ্দিকুর বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু বলার নেই, কারও প্রতি কোনও আক্রোশও নেই। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও আমি কারও বিচার দাবি করছি না। যদি কেউ আইনের বাড়াবাড়ি করে থাকে, তাহলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরাই বিষয়টি দেখবেন।’
আপনি একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে চেন্নাই গিয়েছিলেন, সেই আশা কী এখনও আছে— জানতে চাইলে সিদ্দিকুর বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু আসলে বলতে পারবো না। চিকিৎসকরাই ভালো জানেন। তবে সৃষ্টিকর্তার যদি ইচ্ছা হয়, যদি মিরাকল কিছু ঘটে, তাহলে সেটা সৃষ্টিকর্তার নিয়মেই হবে।’